রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ আগুনে মারা গেছেন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত মেহরান কবির দোলা ও তার ছোট বোন মাইশা কবির মাহি। দোলা আইএফআইসি ব্যাংকে তিন বছর পূর্তি উদযাপন করতে ছোটবোনকে নিয়ে ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন।
মেহরান কবির দোলা বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (সিএসই) বিভাগের ৫৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বোন মাইশা কবির মাহি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ৮০ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে যে, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী মেহরান কবির দোলা (৫৫ ব্যাচ) ও তার বোন মাইশা কবির মাহি (৮০ ব্যাচ) বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডে সংগঠিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মর্মান্তিকভাবে মারা যাওয়ায় তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনাসহ শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হচ্ছে।
শুক্রবার (১ মার্চ) দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ পেজ থেকে ছোট পর্দার অভিনেত্রী সালহা খানম নাদিয়া জানান, বেইলি রোডের আগুনে আমার বান্ধবী দোলা ও তার বোন ইন্তেকাল করেছে। আল্লাহ্ সকলের আত্মার শান্তি দিক আমিন।
আরেক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, এ বছর আর চাঁদ রাতে আমাদের দেখা হবে নারে দোলা। এ ছবিটা যেখানে তুলেছিলাম আমরা বেইলি রোডে, কাল রাতে সেখানেই নিষ্ঠুর আগুনের গ্রাসে তোকে হারাতে হলো আমাদের। তোর হাসিমাখা সহজ সরল মুখটা বোন আজীবন আমাদের কাঁদাবে, অনেক ঘুমাতে ভালোবাসতি। আজকেও দেখলাম নিষ্পাপ শিশুর মতন ঘুমাচ্ছিস। আল্লাহ তোদের পরিবারকে তোদের দুই বোনের এই মৃত্যু শোক সহ্য করার দৈর্য্য শক্তি দিক, তোদের জান্নাতবাসী করুন, আমিন। আমাদের ক্ষমা করে দিস, তোদের বাঁচাতে পারলাম না।
নাঈমের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন পূরণ হলো না
বরগুনা জেলার বড় গৌরিচেনা গ্রামের দিনমজুর বাবার সন্তান নাইম আহমেদ। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা রোজগার করতে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। নিথর নাইম ফিরেছেন বাক্সবন্দি লাশ হয়ে।শুক্রবার দুপুরে ছেলের লাশ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা নান্টু মিয়া বলেন, আমার ছেলে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে অনার্সে ভর্তি হতে চেয়েছিল। আমাকে বলেছিল বাবা তুমিতো খরচ চালাতে পারবে না। আমি ঢাকায় গিয়ে কাজ করে যা টাকা পাব, সেটা দিয়েই ভর্তি হয়ে যাব। তাহলে তোমার আর কষ্ট হবে না। কিন্তু সেটা আর হলো না।
হাতের ঘড়ি দেখে মিনহাজের মরদেহ শনাক্ত করি
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দিন পড়াশুনা শেষ করে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে বছরখানেক ধরে চাকরি করছিলেন। মিনহাজের বন্ধু সৌমিত আহমেদ অরণ্য বলেন, ‘গতকাল রাতে ছোট ভাই আমিন, মিনহাজসহ কয়েকজন রাজধানীর বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। আমিন আর মিনহাজ ছিল কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে। পরে আমিন ফোন করে জানায়— সে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরের পাশ দিয়ে উপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে আর মিনহাজ উপরে। এরপর থেকে দাঁড়াতে পারছে না আমিন। কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে। এরপর আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ফিরে আসি এবং ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আমিনকে রেসকিউ করে হাসপাতালে পাঠাই।’ অরণ্য আরও বলেন, ‘একাধিকবার আমরা মিনহাজের মোবাইল ফোনে কল করেছি কিন্তু রিসিভ হয়নি। সারারাত ধরে মিনহাজকে খোঁজ করেছি, হাসপাতালে খুঁজেছি। সর্বশেষ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটি মরদেহ দেখানো হয়। হাতের ঘড়ি দেখে মিনহাজের মরদেহ শনাক্ত করি।’
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ইটালি যাওয়া হলো না মোবারকের
মাসখানেক আগে ইটালি থেকে দেশে এসেছিলেন সৈয়দ মোবারক হোসেন। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পরিবার নিয়ে ইটালি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু আর ইটালি যাওয়া হলো না তাদের। বেইলি রোডের আগুন কেড়ে নিল পুরো পরিবারের সদস্যদের প্রাণ। মোবারকের চাচাতো ভাই ফয়সাল জানান, রাজধানীর মধুবাগ থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ডিনার করতে গিয়েছিলেন মোবারক। সঙ্গে ছিল স্ত্রী স্বপ্না, ২ মেয়ে সৈয়দা কাশফিয়া ও সৈয়দা নূর এবং একমাত্র ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ। আগুনে পুড়ে সবাই মারা গেছেন। ফয়সাল বলেন, ‘পরিবারটি ইটালিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তাদের আর যাওয়া হলো না। পরিবারের আর কেউ বেঁচে রইলো না।’
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মুহিববুর রহমান বলেছেন, রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। শুক্রবার (১ মার্চ) দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, অগ্নিকাণ্ডের জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না।তিনি বলেন, নিহতদের সৎকারের জন্য সরকার প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দিচ্ছে। পরে তাদের ক্ষতি বিবেচনায় পুনর্বাসনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন মারা গেছেন। ৪০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। ২৬ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনটি সাততলা। ভবনের তৃতীয় তলায় কাপড়ের দোকান বাদে প্রতিটি তলায় ছিল রেস্তোরাঁ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর জানায়, তৃতীয় তলা বাদে প্রতিটি তলায় গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। যে কারণে আগুনের তীব্রতা ভয়াবহভাবে ছড়িয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ৯টা ৫০ মিনিটে মিনিটের দিকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে আগুন লাগে। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টার পর রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় দুই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও এখনও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেছে র্যাব, বিজিবি, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।