চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

ট্রেন টু হায়দ্রাবাদ

KSRM

সুজলা-সুফলা বাংলা! দূরের সবুজ বন। বিস্তৃত ফসলের মাঠ। ধান-পাঠ-পদ্ম-শাপলার বিল, খেজুর বন। সারি সারি তাল গাছ- এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে/ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায় একেবারে উড়ে যায় কোথা পাবে পাখা সে! যেদিকে চোখ যাচ্ছে, জুড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণ। বইছে প্রেমের হাওয়া। বুকের ঠিক মাঝ বরাবর কবিগুরু খেলা করছে- রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা/ভাবিনি সম্ভব হবে কোনোদিন/আগে ওকে বারবার দেখেছি/ লাল রঙের শাড়িতে/দালিম-ফুলের মত রাঙা/ আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়/আঁচল তুলেছে মাথায়!

কী আজব! কী বলছি এসব! আশপাশে কোন দালিম ফুলের মত রাঙা, লাল রঙের শাড়ির কিংবা কালো রেশমের কাপড় পরিহিত আঁচল তোলা কোন রমণী নেই। হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে আমাকে নমস্কার করতেও কেউ আসেনি। তবুও কেন থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা! কেন গড়িয়ে পড়ছে প্রেম!

Bkash July

সত্যি বলতে, দূরপাল্লার ট্রেন যাত্রায় আমার এমন কাল্পনিক ভাবনা আসে। প্রেম গড়িয়ে যায় ঝর্ণার জলের মতো। উছলে পড়ে ঢেউ সাগরের মতো। এ জীবন চলার পথে যদিও দূরপাল্লার যাত্রায় এমন দালিম ফুলের মতো রাঙা, সমস্ত হৃদয় থমকে যাওয়ার মতো কারও দেখা মেলেনি। এ নিয়ে আফসোস হওয়ার মতো একটা ভাব আসলেও তা আফসোস নয়, মানব মনের বাসনা। যা এড়িয়ে যেতে পারবে না কেউ। আমি জানি, এই যে পথ চলি, দূরে কোথাও হারিয়ে যাই একাকী অথবা সঙ্গী হয় অচেনা যেকোনো মানুষ, এটাই হলো দূর যাত্রার আনন্দ। আড্ডা-গল্প-গান- ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলছে রাত দুপুরে ঐ’; শৈশবে পড়া কবিতার মতোই সুন্দর!

আমার সিট টু-টায়ার কামরার আপারে। সিটে উঠবো রাতের ঘুমের সময়। নিচের সিটে বসলাম। কাচের জানালার সাথে গা এলিয়ে দিয়ে হাতে নিই বইটি। মানে ট্রানজিট ১৯৭১! এই বইটিই আমার হায়দ্রাবাদ ট্রেনের প্রথম সঙ্গী! পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে দেখছিলাম, উৎসর্গে লেখা -যাদের আত্মত্যাগ এবং যাদের বীরত্বে আমরা বাংলাদেশ। তার মানে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নিবেদন করে লেখা বইটি। তার ঠিক নিচে অটোগ্রাফ ‘সাইফুল্লাহ সাদেক, বনের মোষ তাড়ানো আরও একজন। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা -জাহিদ নেওয়াজ খান, ২০.০৮. ২০২৩’।

Reneta June

আসলে বছর খানেক পর সাবেক কর্মস্থল চ্যানেল আইতে যাই। আমার সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান গুরু, অন্যতম মেন্টর হলেন এই মানুষটি। চ্যানেল আইয়ের চিফ নিউজ এডিটর এবং চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক। অত্যন্ত সুচিন্তক, লেখক, গবেষক এবং অসাধারণ নেতা। তার তত্ত্বাবধানে চ্যানেল আইতে যৌবনের সবচেয়ে সোনালী প্রায় পাঁচটি বছর কাটিয়েছি, যে সময়টা আমার সবচেয়ে সম্ভাবনার, তেজস্বিতার, কর্মঠ ও নিজেকে প্রস্তুত করার। একারণে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আবেগ একটু আলাদাই।

এর আগে বেশ কয়েকটি জায়গায় কাজের সুযোগ হয়েছে। ছেড়ে আসার পর কোনোটাতেই আর যাওয়া হয়নি সৌজন্যতাবশতও। কিন্তু চ্যানেল আইতে এখনো যাই মাঝে মধ্যেই। ভালো লাগে। মূল কারণ দারুণ একজন নেতা ও মেন্টর ছিলেন আমার। আর তিনি এই বইয়ের লেখক জাহিদ নেওয়াজ খান! বইটি হাতে দিয়ে বললেন, পড়ার পর রিভিউ দিও। অটোগ্রাফ দেখে একেবারেই বিস্মিত হইনি। আমাকে এমন ভালোভাবে আর কেই বা চিনবেন। যৌবনের প্রায় পুরো সময়টাই তো নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে তাড়াতেই চলে যাচ্ছে! আর তার অনেকটাই দেখেছেন তিনি। মেন্টরের উপলব্ধি তাই যথার্থই! আর সেটাই লিখে দিয়েছেন অটোগ্রাফে! ট্রানজিট ১৯৭১ মূলত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। আমি এমন ইতিহাসনির্ভর; বিশেষত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস পড়তেই বেশি ভালোবাসি।

এক কাপ চা হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়া শুরু করলাম বইটি! এরই মধ্যে সামনে এসে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ট্রেনের বাইরের সুন্দর প্রকৃতিসহ আমার ছবি তুলতে শুরু করলো অভিজিৎ। তার ক্যামেরা ধরা দেখে আরেকটু ফিটফাট হয়ে বসলাম। ভালো ছবিই তুলেছে। এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে ট্রানজিট ১৯৭১। বইটির সঙ্গে আজকের যাত্রাও মিলে যাচ্ছে! ঢাকা থেকে এসে কলকাতা ট্রানজিট হয়ে আমার যাত্রা হায়দ্রাবাদ!

সালিমার স্টেশন থেকে আমার কামরাতেই উঠেছে আপন দুভাই-অভিজিৎ আর অরিজিৎ! কথায় কথায় পরিচয় হওয়া তাদের সাথে। বাড়ি হাওড়ায়। অভিজিৎ বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। আর অরিজিৎ পড়ে বিশাখাপত্তনমের একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। অন্ধপ্রদেশের স্মার্ট ও সমুদ্র নগরী বিশাখাপত্তনম।

হায়দ্রাবাদ রাজধানী হওয়ার পূর্বে এটাই অন্ধপ্রদেশের রাজধানী ছিলো। তবে এখন তেলেঙ্গেনা আর অন্ধপ্রদেশ দুটোর রাজধানীই হায়দ্রাবাদ। তথাপিও বিশাখাপত্তনমের আর্থিক কিংবা আত্মিক মূল্য কমেনি। এটি চেন্নাই ও কলকাতার পরে ভারতের পূর্ব উপকূলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর এবং দক্ষিণ ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম শহর। এই শহরের স্কুলেই তাকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে বড় ভাই অভিজিৎ। সারা পথে মোবাইল গেমস খেলতে খেলতেই যাচ্ছে অরিজিৎ। আর অভিজিতের সঙ্গে আমার জম্পেশ আড্ডা চলে। গল্প করতে করতে ক্ষুধা লেগে যায়। চা আসে। চা খাই। কফি আসে, কফিতে চুমুক দেই। চিপস খাই। গল্প করি। বিকেল গড়িয়ে সূর্য হেলে পড়ছে তার কক্ষপথে! এরই মধ্যে বাংলার সবুজ মাঠ-ঘাট পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করি নবাব সিরাজের আরেক শহর উড়িষ্যায়।

সবুজের, মাঠের-ক্ষেতের কিংবা গ্রামের রূপের যদিও কোন পরিবর্তন নেই। কেনই বা থাকবে! বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা; এই মিলেই তো একটা সময় ছিলো একই রূপের, একই রঙের ও একই সাম্রাজ্যের। মাঝখানে মীর জাফরের জন্ম না হলে হয়তো এই তিন শহর মিলেই হয়ে যেতো নতুন স্বাধীন দেশ! প্রায় সব সফলতার ভেতরে একজন এমন মীর জাফর ঢুকে পড়ে আর সব তছনছ করে দিয়ে যায়! তাই সতর্ক থাকতে হয়। সিরাজ সতর্ক থাকতে পারেনি। যদিও ইতিহাসের পাতায় তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা, কিন্তু তিনি মীর জাফরের চক্রান্তের শিকার। তবে মীর জাফরের পরিণতি হয়েছিলো ভয়াবহ! রবার্ট ক্লাইভ তাকে তার গাধায় পরিণত করলেও পরে বহিষ্কার করে। একসময় নির্মম পরিণতি হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে জঙ্গলে একাকিত্বে মৃত্যু হয় তার! মীর জাফরেরা কখনো বিজয়ী হয় না! সিরাজদের যদিও সাময়িক ক্ষতি হয়। কিন্তু ইতিহাসে তাদের নামই থেকে যায় স্বর্ণাক্ষরে। নিশ্চয় এই উড়িষ্যা শহরের পরতে পরতেও সিরাজ-উদ-দৌলার নাম লেখা আছে, মানুষের মুখে মুখে এখনো তার গল্প ঘুরে!

এখন বিকেল! এরই মধ্যে আমরা উড়িষ্যার কয়েকটি স্টেশন অতিক্রম করেছি। ট্রেন আর গল্পের ছন্দে ছন্দে রাতের খাবারও অর্ডার করে ফেললাম। তাদের দুজনের জন্য অর্ডার করতে গিয়ে আমারটাও যুক্ত করে নেয় বাঙালি বাবু অভিজিৎ। আতিথেয়তা দেখালো বেশ। ও দাদা খেয়ে এসছেন নাকি গিয়ে খাবেন -এসব তথাকথিত আলাপ মিথ্যে এখানে। অভিজিৎ মনের গভীর থেকেই বাংলাদেশের একজন বাঙালিকে আপন করে নিয়েছে। যদিও তার ওপর পয়সা চাপিয়ে দিইনি। কিন্তু অচেনা ট্রেন যাত্রায় অ্যাপের মাধ্যমে ট্রেনের বাহিরের খাবার অর্ডার করাটা বিশাল কিছু! ইস্ট-কোস্ট ট্রেনটি কিছুটা মধ্যম সারির। খাবারও নিশ্চয় তেমনটাই হবে। টিকিটের সঙ্গে খাবার নেই এই ট্রেনে। যদিও ফার্স্ট ক্লাস কামরায় আছি আমরা। সবই দুর্দান্ত। কিন্তু প্রায় প্রতিটি স্টেশনে দুই-পাঁচ/দশ মিনিট করে থামে। যাত্রী তুলে ও নামায়। আবার স্টেশন শূন্য করে চলে যায় অন্য স্টেশনে।

হায়দ্রাবাদের বেস্ট ট্রেন মূলত ফলকনামা। কোথাও না থেমেই একটানা চলতে থাকে। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগেও অনলাইনে টিকিট পাওয়া যায়নি তার। তাপস দাসই ট্রেনের টিকিট বুকিং করে রেখেছিলেন। তাপস প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষক। গবেষণার এরিয়া মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশ আর বাঙালির প্রতি তার আলাদা দরদ। গতবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদের হয়ে রিসার্চ ট্যুরে কলকাতায় তাপসের সঙ্গে সম্পর্ক। এরপর থেকে আত্মার মানুষ হয়ে গেছেন। একবার শুধু বলেছিলাম, হায়দ্রাবাদের টিকিট কীভাবে করতে পারি? বললেন, আমি কেটে রাখবো। তিনি ফলকনামা পাননি। পেয়েছেন ইস্ট-কোস্ট। তবে ফলকনামায় টিকিট না পাওয়াটাই আমার জন্য শাপেবর হয়েছে। পরে জর্জ বিশ্বাসের কাছে জানতে পারি, ওই তারিখে ফলকনামা বাতিল হয়েছে!

ঢাকায় থেকে আগের দিন কলকাতা শহরে প্রবেশ করে আমার বন্ধু জর্জ বিশ্বাসের বাসাতেই উঠেছিলাম। রাতটি তার বাসাতেই কাটিয়ে দেই। যদিও বর্ডার পার হতে হতে কথা হচ্ছিলো সাঈদ উল ইসলাম ভাইয়ের সাথে যে, কলকাতায় পৌঁছেই তাকে দেখতে যাব। কলকাতার সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক সাঈদ ভাই বাইক দুর্ঘটনায় বেডরেস্টে আছেন কিছুদিন ধরে। যাদবপুর থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানে পিএউচডি করা সাঈদ ভাই আমার কতটা প্রিয় তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। কলকাতায় গেলে আমি প্রায় সময় তার বাসাতে উঠি, তিনি আপন ভাইয়ের মত যত্ন নেন। আর আমি তার ছিটেফোটাও তার জন্য করতে পারি না। এ ভেবে আমার প্রায়ই অনুভূতি তিক্ত হয়ে উঠে! মানুষটির দুর্ঘটনার কথা শুনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। বনগাঁ থেকে ট্রেন শিয়ালদাহ ঢুকতে ঢুকতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। ফলে আর যাওয়া হলো না পাটুলিতে। জর্জ বললো, ফেরার পথে দেখে যেও৷ রাতটা জর্জের বাসায় কাটিয়ে সকালে উঠে ডিম সেদ্ধ, খেজুর, দুধ ইত্যাদি খেলাম। এরপর প্রিয় মুন্নাদা্র রেস্টুরেন্টের সিগনেচার ডিশ খেলাম। মুন্নাদা কলকাতা রানার্স গ্রুপ প্যান্থার্স এর অন্যতম সদস্য। তার রেস্টুরেন্টে খেলে কোনো পয়সা-কড়ি নেন না। জর্জই পরিচয় করিয়েছে আমাকে। জর্জ জানালো, মুন্না দা কখনো প্যান্থার্সের রানার্সদের কাছ থেকে পয়সা রাখেন না। এবারও নিলেন না। জোর করার পরও না। এমন ডোনার কোথায় পাওয়া যায় আর!

মুন্নাদার ব্রেকফাস্ট করিয়ে জর্জ আমাকে সালিমার স্টেশনের জন্য বাইক বুক করে দেয়। আমি বাইকে চড়ে বসি। সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে। দু’শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একসময়কার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বর্তমান প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জর্জ বিশ্বাস। দুর্দান্ত মজার মানুষ। অসাধারণ শিক্ষক। পড়ানোর ধরণ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার কথা সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে। বাংলাদেশে আমন্ত্রণে গিয়ে তো রীতিমত সেলেব্রেটি বনে গিয়েছে। শত শত তরুণীদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। তরুণরদেরও কম নয়। একজন প্রো লেভের ম্যারাথনারও। ৮৭টি ম্যারাথন সম্পন্ন করেছে এরই মধ্যে! বিরাট ব্যাপার বটে! এখন পিএইচডির সাবমিশনের প্রস্তুতি চলছে তার। অনেক ব্যস্ততার ভিড়েই আমাকে সময় দিয়েছে। প্রতিবারই দেয়। কখনো বিরক্তিবোধ করে না। ভালোবাসে প্রচুর। আমি তার প্রতিদান দিতে পারি না!

আসলে পদে পদে এমন বন্ধু-ভাই-শুভাকাঙ্ক্ষি ও কাছের মানুষদের ছায়া আমাকে উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এখন আর কোন কাজকেই কঠিন মনে হয় না। কোন যাত্রাতেই শঙ্কা জাগে না। সবকিছু সহজ। সবকিছুই হাতের মুঠোই মনে হয়। বদ্ধ ঘর ছেড়ে ঘরহীন হতে মন চায় বারবার। দূরে কোথাও ঘুর্ণিপাকে কীভাবে মানুষ কীসের নেশায় ছুটছে সে নেশায় আমারও মত্ত হতে মন চায়। আর তাই ট্রেনের দূর পাল্লার যাত্রা আমার কাছে একটা নেশার মতো। এই নেশায় মত্ত আছি এই মুহূর্তে।
রাত ৯টা বাজে। কটক স্টেশনে ১০ মিনিট থামে ট্রেন। আমাদের অর্ডার করা রাতের খাবার এসে পড়লো। খাবার খেয়ে কিছু সময় আবারও গল্প হয়। রাত ঘনিয়ে আসে। এরই মধ্যে আমরা সালিমার থেকে পেছনে ফেলে এসেছি ছাত্রাগাছী জংশন, মেঁচেদা, পাঙছোরা, খড়কপুর জংশন, বেলদা, জলেশ্বর, রূপসা জংশন, বেলাশুর, সোরো, ভাদ্রাক, বায়তারানি রোড, জাজপুর রোড, কটক, বারাঙ জংশন এবং উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর স্টেশন পেরিয়ে চলছি অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে। গভীর রাত। বাইরে বিদঘুটে অন্ধকার, পাহাড়ি ও বিস্তৃত বিলের মাঝখানে রেলপথ। ছুটে চলেছে ট্রেন।

বিছনায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবছি, এই যে দূরের শহরে যাচ্ছি; এই যাত্রার প্রস্তুতি তো এতো সহজ ছিলো না। এটি অনেকদিনের ইচ্ছে, পরিকল্পনার ফল। এর পেছনে কত মানুষের অবদান, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা; ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি! মানুষ এতো ভালোবাসে, এতো সহযোগী! ক্ষুদ্র এ জীবনকে কতোটা সুন্দর, বর্ণিল মনে হয় মাঝে মাঝে।

এই চলার পথে শুরুতেই আমার যে মানুষটার কথা মনে পড়ছে তিনি মিনহাজ উদ্দীন মিরান। গ্লোকাল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী। তারই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও ই-লার্নিং প্লাটফর্ম এডুসেন্ট্রিক এবং ট্যুরিজম প্লাটফর্ম ট্রাভেলপ্লিজ। মিরান ভাই বিরাট স্বপ্নবাজ মানুষ। ব্যবসার সাথে দেশের প্রতি ত্যাগ ও তারুণ্যের প্রতি ভালোবাসা, ইতিবাচক কর্মের প্রতি ও দেশের ভবিষ্যত হেলদি প্রজন্ম গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেন, সময় দেন, পড়েন, ভাবেন। ভালো কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আমি যেদিন হায়দ্রাবাদসহ চলতি বছরে ব্যাংকক, মুম্বাই ও কলকাতা ম্যারাথনের পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে কথা বলি, সাথে সাথেই বলেছেন, ‘আমি তোমার সাথে আছি, সকল ধরণের সহযোগিতা করবো’। এমন সহযোগী ও উদার মানুষের দ্বারাই সম্ভব নতুন কিছু করা, নতুন ভোর আনা। আজকের এই যাত্রা পথে তাই তার অবদান অনস্বীকার্য। আমরা একত্রে দেশের জন্য অনেক কিছুই করার কথা ভাবছি। হয়তো একদিন করতে পারবো। দেশটাকে আপন মহিমায় গড়ে তুলতে পারবো।

এই দেশের জন্য যে সকল তরুণ কাজ করছে ও আপন মহিমায় দেশ গড়ার তরে সময় দিচ্ছে তাদেরই অন্যতম একজন মোঃ ইসতিয়াক উদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে সেই যে একসাথে চলছি আমরা, আজ অবধি অটুট বন্ধন। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য থেকে ৬ বছর পর সেই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি তিনি এখন। একজন ট্রায়াথলেট। ম্যারাথনার, আয়রনম্যান, ওশানম্যান, বাংলা চ্যানেল বিজয়ী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই পুরোদস্তুর এথলেট একজন। গড়ে তুলেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি রানার্স কমিউনিটিও। সে কমিউনিটি থেকে রানারদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে৷ শুধু তাই নয়, করোনা মহামারি দু:সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে দিয়েছে প্লাজমা সাপ্লাই, গড়ে তুলেছে প্লাজমা ব্যাংক বাংলাদেশ। নিয়মিত রক্তদাতাও সে! আর কাজ করছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণেও। আমার ম্যারাথনের প্রতি সব সময় যত্ন, সহযোগিতা ও উৎসাহ যুগিয়ে পাশে থাকা ইসতিয়াকের কথা যেমন আমার এই ট্রেনে যেতে যেতে মনে পড়ছে, তেমনি গভীরভাবে ভাবছি আমার সব সময়কার শ্রেষ্ঠ মেন্টর, নেতা ও অভিভাবক শাকিল মালিকের কথা। সুদূর আমেরিকায় থাকেন। সেখানেই সকল কিছু। অফিস, শিক্ষকতা, ব্যবসা ও জীবনযাত্রা। সেখান থেকেই সারাবিশ্বের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করেন। একইভাবে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ও শিক্ষায় এগিয়ে যেতে দেশকে সহযোগিতা করছেন, তরুণদের অনুপ্রাণিত করছেন। সেই সুবাধেই উনার সান্নিধ্য পাওয়া আমার। ক্ষুদ্র এ জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তির মধ্যে এই মানুষটিকে পাওয়াই সবার থেকে এগিয়ে নি:সন্দেহে! আমার ম্যারাথনে যুক্ত হওয়া দেখে তিনি নিজেনই উদ্বুদ্ধ করছেন, অনুপ্রাণিত করছেন। এই যে দেশ-বিদেশে ম্যারাথনের পেছনে ছুটছি এর অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক তিনি, আমার সাহসের বাতিঘরও।

এমন কত মানুষই আছেন এই লেখায় যাদের নাম উল্লেখ না করলেও মনের অন্তরালে লেখা আছে প্রত্যেকের নাম। হয়তো অন্য কোথাও কোনোভাবে তাদের কথা বেরিয়ে আসবে, বলবো, লিখবো!

এই চলন্ত ট্রেনের গভীর রাতে চাঁদ কি উঠেছে আকাশে৷ ছাদ খোলা ট্রেন হলে হয়তো জোছনা বিলাস করতে করতেই যেতাম৷ পৃথিবীতে নিশ্চয় কোথাও না কোথাও এমন ট্রেন আছে। যদিও জানি না যে, আকাশে চাঁদ উঠলো কি উঠলো না। সকাল হলেই হয়তো শুনতে পাবো, ভারতের পাঠানো চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দেশে পা ঠিকই রেখেছে। আর ইতিহাস গড়ে মাতোয়ারা হয়েছে পুরো ভারতবাসী। এই কথা মনে করেই গা শিউরে উঠছে যে, যেদিন ভারতের চন্দ্রযান চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণ করবে, সেদিনেই আমি ভারতের দাক্ষিণ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর হায়দ্রাবাদে পৌঁছে যাবো!

**চলবে**

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View