শিশুসাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবে পরিচিত টিআই এম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া। কয়েকটি ছড়ার বই ছাড়াও ‘হরর ক্লাব’ নামে শিশুদের জন্য সিরিজ বই আছে তার। পরিচয় সুনামের মনে হলেও আড়ালে তিনি ভয়ঙ্কর, বিকৃত মানসিকতার। তিনি বাংলাদেশে বসে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িত থাকার কারণে অনেক দেশে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০১৪ সালের জুনে প্রথম গ্রেপ্তার করেছিল টিপু কিবরিয়াকে। তখন ওই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়। দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে থাকার পর তিনি ২০২১ সালে কারামুক্ত হন। এরপরও স্বভাব বদলায়নি টিপু কিবরিয়ার।
নজরদারিতে থাকা টিপু কিবরিয়াকে আবার গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে কামরুল ইসলাম নামক সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি’র স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এন্টি ইলিগ্যাল আর্মস রিকোভারি টিম।
আজ বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার ফকরুজ্জামান এক সময়কার খুব জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। তিনি টিপু কিবরিয়া নামে পরিচিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৭ সালে বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৮৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯১ সালে সেবা প্রকাশনীর মাসিক কিশোর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি শিশু সাহিত্য রচনা করতেন। তার অর্ধ শতাধিক এর উপরে বই রয়েছে যার বেশিরভাগই সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ২০০৫ সাল থেকে শিশু পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও বিতরণের সাথে জড়ান টিপু কিবরিয়া। দীর্ঘদিন এই অপরাধের সাথে জড়িত থাকার পর ২০১৪ সালে সিআইডির কাছে গ্রেপ্তার হন এবং তার নামে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়। ২০২১ সালে জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন টিপু কিবরিয়া। “একশো এক” নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করে। একই সাথে, সাহিত্য চর্চার আড়ালে পুনরায় শিশু পর্নোগ্রাফির সেই পুরনো পথেই হাঁটতে শুরু করেন টিপু কিবরিয়া।
সিটিটিসি জানায় ফকরুজ্জামান ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি কন্টেন্ট বানান। তিনি নিজে গুলিস্তান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাংবাদিক বেশে ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের সামান্য কিছু অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজের বাসায় ডেকে এনে তার নিজের ক্যামেরার সাহায্যে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির নগ্ন ছবি, শরীরের বিভিন্ন গোপনাঙ্গের ছবি তোলে এবং ভিডিও করেন। নিজের বাসা ছাড়াও বিভিন্ন পার্কের নির্জন ঝোপঝাড়ে এই ছিন্নমূল ছেলে শিশুদের একই প্রক্রিয়ায় অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। এই ছিন্নমূল ছেলে শিশুদের সংগ্রহ করার জন্য তার কয়েকজন সহযোগীও রয়েছে। যাদের মধ্যে একজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিকভাবে তার ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো হতে প্রায় ২০ জন পথশিশুর ছবি ভিকটিম হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
পরবর্তীতে এই অশ্লীল ছবিগুলো বিভিন্ন নিষিদ্ধ ও পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইটে আপলোড করেন। এ সকল ওয়েবসাইটগুলো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষগুলোর একধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যার অধিকাংশ সদস্য মূলত উন্নত বিশ্বের মানসিক বিকারগ্রস্থ নাগরিকরা। এই ওয়েবসাইটগুলো থেকেই টিপু কিবরিয়ার আপলোড করা ছবিগুলো দেখে অনেক বিকৃত রুচির ব্যক্তিরা তার সাথে যোগাযোগ করে। তারা টিপু কিবরিয়ার কাছে ছেলে শিশুদের বিভিন্ন রকমের অশ্লীল ছবির চাহিদা দেয় এবং টিপু কিবরিয়া অর্থের বিনিময়ে ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের ব্যবহার করে তাদের চাহিদা চরিতার্থ করেন।
অভিযান পরিচালনার সময় তার বাসায় তার ব্যবহৃত ডেস্কটপটি পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি দু’টি এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও জর্মানির নাগরিকসহ প্রায় ২০/২৫টি আইডি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যারা এসব আইডি দিয়ে মূলহোতা টিপু কিবরিয়ার সাথে শিশু পর্নোগ্রাফির বিভিন্ন কনটেন্টের জন্য যোগাযোগ করতো।
এছাড়া তার ব্যবহৃত ক্যামেরা, পিসি ও ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২৫০০ শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা স্থির চিত্র ও প্রায় ১০০০ ভিডিও কনটেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার ডেস্কটপে অসংখ্য ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের প্রচুর অশ্লীল ছবি ও ভিডিও পাওয়া গিয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, মাত্র ৫০০, হাজার টাকার প্রলোভনে তিনি ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে আসতেন। তার চক্রে আরও অনেক সহযোগীর নাম আমরা পেয়েছি। আমরা দুজনকে গ্রেপ্তারের সময় একজন ভুক্তভোগী শিশুকে উদ্ধারের পর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
কী পরিমাণ টাকা তিনি পেতেন, কিভাবে পেতেন জানতে চাইলে ডিএমপি’র এ অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, অর্থের লেনদেন হতো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও কিছু এমএফএস এর মাধ্যমে। তিন থেকে চারটি ছোট ছোট ভিডিও পাঠালেই তিনি পেতেন হাজার ডলার। সর্বশেষ এক বিদেশী গ্রাহককে তিনি তিনটি পর্নোগ্রাফিরি ভিডিও পাঠিয়ে এক হাজার ডলার পেয়েছেন। তার দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এজেন্ট। এরকম আমরা বেশ ক’জন এজেন্টকে শনাক্ত করেছি।