বাংলা সিনেমা মানেই যেন শাকিব খান! তাই মূলধারার সিনেমায় তার বিকল্প নেই বলে অনুভব করেন পরিচালক-প্রযোজকরা। গত ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় ৪৬টির মতো ঈদ পেয়েছেন শাকিব খান। যেখানে তার ১০০-এর বেশি সিনেমা মুক্তি পায়।
সিনেমা সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশিরভাগ সিনেমাই সুপারহিট। তারা বলেন, ২০০০ সালে ঈদুল ফিতরে ‘ফুল নেব না অশ্রু নেব’র মাধ্যমে প্রথম শাকিব খানের সিনেমা ঈদে মুক্তি পাওয়া শুরু হয়। একই বছর ঈদুল আযহায় ‘হিরা চুনি পান্না’ ও ‘জানের জান’ দুটি সিনেমা মুক্তি পায়। ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙা করতে শাকিবের ঈদের সিনেমাগুলো অক্সিজেনের মতো কাজ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৫ সালের ঈদুল আযহাতে ছিল না শাকিবের কোনো সিনেমা। আর ২০২০ সালে করোনাকালে সিনেমা হল বন্ধ থাকায় নতুন সিনেমা মুক্তি পায়নি। প্রযোজক সমিতি এবং প্রদর্শক সমিতির হিসেবে, চিত্রনায়ক মান্না বেঁচে থাকাকালীন ২০০৭ সালের ঈদুল ফিতরে ‘কথা দাও সাথী হবে’, ‘তোমার জন্যে মরতে পারি’, ‘মা আমার স্বর্গ’, ‘কপাল’, ‘দানব সন্তান’ এই পাঁচটি মুক্তি পেয়েছিল শাকিবের। পরের বছর ঈদুল ফিতরেও শাকিব খান বাজীমাৎ করে হয়ে ওঠে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’!
তার অভিনীত এক টাকার বউ, মনে প্রাণে আছো তুমি, যদি বউ সাজো গো, আমাদের ছোট সাহেব, হৃদয় আমার নাম এই পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পায়। পরপর দুই ঈদে দশটি সিনেমা মুক্তি দিয়ে ব্যবসায়িক সাফল্য উপহার দিয়ে রেকর্ড গড়েন শাকিব। ‘মনে প্রাণে আছো তুমি’র প্রযোজক হার্টবিট প্রডাকশনের কর্ণধার তাপসী ঠাকুর বলেন, ২০০৭ সালেই শাকিবের রমরমা অবস্থা। এ সিনেমা থেকে কয়েক কোটি টাকা লাভ করি। তখন থেকে সব সিনেমায় শাকিবের নামের আগে ‘সুপারস্টার’ উপাধি দেয়া হতো।
শাকিব খানের বর্ণিল ক্যারিয়ারে ২০০৯ ও ২০১২ সালের ঈদে চারটি করে সিনেমা মুক্তি পায় এবং তিনটি করে সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ১৩ বার। সিনেমায় নতুন জাগরণ তৈরি করে শাকিবের শিকারী, নবাব সিনেমাগুলো। সিনেমা হল মালিক ও পরিবেশকদের মতে, ঈদে সংখ্যায় বেশি ও ব্যবসায়িক হিটের হিসেবে এসব রেকর্ড শাকিব ছাড়া আজও কেউ করতে পারিনি।
তবে প্রায় ১৮ বছর পর এবারের ঈদুল আযহায় চিত্র অনেকটাই অচেনা। নেই শাকিবের কোনো সিনেমা। ‘লিডার আমি বাংলাদেশ’ এবং ‘অন্তরাত্মা’ নামে দুটি সিনেমা থাকলেও সিনেমা দুটির প্রযোজকরা মুক্তি দেননি। সিনেমা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রবীণ অনেকেই বিষয়টি যেন মানতেই পারছেন না! তারা বলছেন, শাকিব না থাকায় সিনেমার ঈদের আনন্দ অনেকটা মলিন।
এদিকে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি জানায়, শাকিব খানের কোনো সিনেমা না থাকায় গত রোযার ঈদের চেয়েও এবার সিনেমা কমেছে । বন্ধ সিনেমা হল খোলাসহ গতবার প্রায় ১৭৫টি সিনেমা হল খোলা ছিল। কিন্তু এবার ৩০/৩৫টির মতো হল কমেছে। ঈদে প্রায় ১৪৩ সিনেমা হলে দিন দ্য ডে (১০৯), পরাণ (১৫) ও সাইকো (১৯) এই তিনটি সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে।
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বলেন, বাকি কিছু হল খোলা আছে যেখানে শাকিবের পুরাতন সিনেমা গলুই, বিদ্রোহী চলছে। এছাড়া কয়েকটি সিনেমায় চলছে শান ও বিক্ষোভ। শাকিবের নতুন সিনেমা না থাকায় সেভাবে বন্ধ সিনেমাগুলো খোলেনি। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের।
সিনেমাপাড়া কাকরাইলের ভুঁইয়া ম্যানশনের একাধিক পরিবেশক শাকিবকে ঈদের সিনেমার ‘প্রাণ ভোমরা’ বলে মনে করেন।
গত ২৬ বছরে শত শত সিনেমা পরিবেশনার সঙ্গে জড়িত এম এম মঞ্জুর রহমান। বর্তমানে টিওটি ফিল্মসের পরিবেশক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, যতো সিনেমাই থাকুক সারা বছর শাকিবের সিনেমা নিয়ে হল মালিকদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকে। টাকা বেশি দিয়ে হলেও দর্শক চাহিদার কারণে হল মালিকরা সবার আগে শাকিব খানকে চায়।
তিনি বলেন, ঈদে শাকিব অভিনীত ছবি নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগে। শাকিবকে সরাতে পলিটিক্স হয়! সারাদেশ থেকে অফিসে এসে হল মালিকরা বসে থাকতো ঈদে শাকিবের সিনেমার জন্য। এবার শাকিব খানের সিনেমা না থাকায় সেই তোড়জোড় নেই। ঈদের আগে সিনেমা রিলিজের ব্যবস্তায় নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতাম। এবার তাও নেই। আমরা যারা সিনেমার মানুষ আমাদের আসলে শাকিবের সিনেমা ছাড়া ঈদ হয় না।
২০১৩ সাল থেকে সিনেমা হলের অপারেটর হিসেবে নারায়ণগঞ্জের মেট্রো, গাজীপুরের বর্ষা, রংপুরের শাপলা, বগুড়ার মধুবন মাল্টিপ্লেক্সে কাজ করছেন আবদুর রহমান। লম্বা সময়ে তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে বললেন, দর্শকের কাছে শাকিব খানের বিকল্প নেই। এবার ঈদে শাকিবের ছবি নেই বলে ঈদের ছবি নিয়ে আলোচনা কম। সিনেমা হলের মানুষদের মধ্যে উদ্দীপনা কম। শাকিব ছাড়া সিনেমার ঈদ যেন অপূর্ণ মনে হচ্ছে। আগামীর প্রতি ঈদে কম হলেও একটি করে শাকিব খানের সিনেমা চাই।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার নওশাদ বলেন, মধুমিতায় একচেটিয়া শাকিবের দর্শক। এমনও হয়েছে শাকিবের ঈদের সিনেমা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা লাভ করেছি। ‘নবাব’ মুক্তির পর ৪ দিনেই ১০ লাখ টাকার বেশি ব্যবসা হয়। এতগুলো বছর সে ইন্ডাস্ট্রি লিড দিচ্ছে, তাই ঈদে তার সিনেমা না থাকা ইন্ডাস্ট্রির জন্যই লোকসান এটা হল মালিকরা বুঝছে।
কিংবদন্তী পরিচালক কাজী হায়াৎ বলছিলেন, ঈদে শাকিবের সিনেমা নেই শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তার সিনেমা না থাকলে সিনেমার মানুষদের ঈদ হয় কেমন করে? কথা প্রসঙ্গে দাঙ্গা, ইতিহাস, কষ্ট, আম্মাজানসহ বহু সিনেমার জনপ্রিয় কাজী হায়াত বলছিলেন, শুধু ঈদে শাকিবের যতগুলো হিট সিনেমা আছে, অনেকের পুরো ক্যারিয়ারে ওতগুলো সিনেমা সংখ্যায় নেই।