পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান। দেশটি সূর্যোদয়ের দেশ নামে পরিচিত। দেশটির সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা, মানুষের সময়ানুবর্তীতা, নিয়ম-রীতি, কাজের প্রতি ভালোবাসা দেখলে যে কেউই অবাক হবে। তবে এত কিছুর পরও দেশটিতে দেখা দিয়েছে এক চাপা ভয়। জাপানের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় এবং সেটা অনেক দ্রুত গতিতে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত একটি সময় প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না ভূখণ্ডটিতে।
বিগত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে জাপানের জনসংখ্যা। ২০০৯ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ১২৮ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন। সেখানে ২০২৩ সালে এসে এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১২৪ দশমিক ৪০ মিলিয়নে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালে এই সংখ্যাটা ৮০ মিলিয়নে নেমে আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ম্যাক্রো ট্রেন্ডসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে জাপানের জনসংখ্যার হার ২০২২ এর তুলনায় কমেছে দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২২ সালেও এই সংখ্যাটা ছিল একই। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটা ছিল দশমিক ৫০ শতাংশ।
জাপানের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো জন্মহার কমে যাওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়া। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দেশটিতে প্রতি হাজারে জন্ম নেয় ৭ দশমিক ১৩ জন যা ২০২২ সালের তুলনায় কমেছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২২ সালে পরিমাণটা ছিল ৭ দশমিক ১০৯ জন, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর দেশটিতে মাত্র ৮ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে, যা ১৮৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন।
অন্যদিকে, প্রতি হাজারে মৃত্যুবরণ করছে ১১ দশমিক ৫২৩ জন। যার অংকটা ২০২২ সালে ছিল ১১ দশমিক ৩০৪ জন।
এই জন্মহার হ্রাস এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধির পরিমাণ দেশটিকে ক্রমাগত জনসংখ্যা হ্রাসে ঝুঁকিতে নিয়ে যাচ্ছে। এই সংবাদ প্রকাশের আগ পর্যন্ত ‘কান্ট্রি মিটার ডট ইনফোর’ লাইভ ডাটা থেকে দেখা যায়, আজ দেশটিতে জন্ম নিয়েছে ২০৮০ জন যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ২৫১৪ জন।
সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ জাপানের সোজিও জেলার কাওয়াকামি গ্রামে বিগত ২৫ বছরে মাত্র একটি শিশু জন্ম নিয়েছিল। তার জন্ম অনেক গ্রামবাসীর কাছে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ছিল। শিশুটির নাম কেনতারো ইয়োকোবোরির। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৭ বছর।
চলমান অবস্থা চাপে ফেলবে দেশটির অর্থনীতিকেও। প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিবে কর্মী সংকট। ফলে শ্রমবাজারে ঘাটতির তৈরি হবে, যা মোকাবেলায় হিমশিমই খেতে হবে এত বড় অর্থনীতির দেশটিকে। জাতিসংঘের মতে জাপান ‘অতি বয়স্ক’ মানুষের দেশে পরিণত হয়েছে। কেননা দেশটির ২৯ শতাংশের বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। অন্যদিকে গত বছর দেশটিতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা রেকর্ড হারে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশে।
জাপানের এই চলমান সমস্যা নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগে’র অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের সাথে।
তিনি বলেন, বর্তমানে জাপান বিশ্বের ১১ তম জনসংখ্যার একটি দেশ। দেশটি ১৯৯০ সালে ৭ম অবস্থানে ছিল। এর কারণ হল জন্মহার কমে যাওয়া। যেটাকে আমরা বলি, মোট প্রজনন হার কমে যাওয়া। যার মানে, ১৫ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত এক নারী কয়টি বাচ্চা জন্ম দেয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি জাপানে এর হার ১ দশমিক ৩ বা ৪ এর মতো। এটি প্রতিস্থাপনযোগ্য জনসংখ্যার যে হার তার নিচে অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এর হার হতে হয় ২ দশমিক ১ ।
মঈনুল ইসলাম বলেন, এর অন্যতম কারণ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা, শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়া, মেয়েদের দেরিতে বিয়ে করা, সন্তান জন্মদানে অনাগ্রহ। তাছাড়া বিয়ের পর শ্রম বাজারেও নারীরা অংশগ্রহণ করছে। আবার বিয়ে না করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।
এতে জাপানের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ তা কমে যাচ্ছে। এতে একটি সময় গিয়ে তাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে তাদের অর্থনীতিতে।
তিনি বলেন, দেশটিতে ৬৫ বছরের বেশি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রবীণ মানুষের সংখ্যা জাপানে অনেক বেশি। প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং জন্মহার কমে যাওয়ায় এক ধরণের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় চাপে পড়বে অর্থনীতিতে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমান জিডিপি ধরে রাখতে তাদের কর্মঘণ্টা আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমানের থেকে ২ দশমিক ৫ গুণ বাড়াতে হবে। কিন্তু তা বাস্তবসম্মত নয়।
তিনি আরও বলেন, জাপানের এই মুহূর্তে দরকার প্রজনন হার বাড়ানোর জন্য যৌক্তিক কর্মসূচি নেওয়া। তা হতে হবে পরিবার কেন্দ্রিক। আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে জনগণকে। যে সকল নারীরা শ্রম বাজারে আছে তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
মঈনুল ইসলাম বলেন, যৌক্তিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তারা ঠিক করবেন যে, কয়টি সন্তান নিবেন বা কখন নিবেন। সরকারকে তাদের এই যৌক্তিক সিদ্ধান্তে সহয়তা করতে হবে।
মঈনুল ইসলাম আরও বলেন, ১৯৯৪ সালের কায়রো সম্মেলনে স্বাস্থ্য, অধিকার এবং প্রজনন বিষয়ক একটি সমঝোতায় বলা ছিল, কেউ কারও ওপর জোর করতে পারবে না। সন্তান জন্মদান চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। তা হতে হবে আলোচনার ভিত্তিতে।
তিনি বলেন, সরকার চাইলেই সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে বাধ্য করতে পারবে না। সরকার তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। পাশাপাশি শ্রম বাজারের ঘাটতি কমাতে, বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসতে পারে। নারীদের দেরিতে বিয়ে করা থেকে কিছুটা এগিয়ে আসতে পরামর্শ দিতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতিকে ধরে রাখতে হলে, প্রবীণদের জমানো অর্থকে পুনরায় ব্যবহার করতে হবে, শ্রম বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
এদিকে গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী কিশিদার সরকার ‘আগে সন্তান’ নীতির ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, জাপান এক খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। জাপানিজরা টিকে থাকবে কিনা এখন সেটাই প্রশ্ন। তিনি জন্মহার বাড়ানোর জন্য ‘অভূতপূর্ব’ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন৷
এই অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় দেখা যায়, এর পেছনের অন্যতম কারণগুলো হলো: সন্তান পালনের অধিক খরচ, অল্পবয়সীদের বিয়ে না করা এবং সন্তান না নেওয়ার প্রবণতা। ২০২২ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘জেফরিজে’র গবেষণায় দেখা যায়, একটি শিশুকে লালন-পালনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্থানগুলির মধ্যে একটি জাপান।
এখন দেখার পালা এই সমস্যা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাবে জাপান। কি পদক্ষেপ নিবে দেশটির সরকার? নাগরিকরা কি অংশ নেবে এই সংকট মোকাবিলায়? ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশের জন্য কি উদাহরণ তৈরি করতে পারবে দেশটি?