এই তো দু’দিন আগে (১৬ মে ২০২৩) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স, সুইস কন্ট্যাক্ট এবং পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া -এর যৌথভাবে ‘চরাঞ্চলের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা: চরের জন্য জাতীয় বাজেট’ -এই শিরোনামে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স -এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। সভাপতিত্ব করেন পল্লী উন্নয়ন, সমবায় মন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য এমপি। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. মশিউর রহমান ছিলেন স্বাগত বক্তা। বক্তা হিসেবে আরও ছিলেন সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সৈয়েদা জিনিয়া রশিদ।
পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, বগুড়ার যুগ্ম পরিচালক মো. আব্দুল মজিদ প্রামানিক পিএইচডি এবং এমফোরসি, সুইসকন্ট্যাক্ট-এর টিম লিডার, আব্দুল আওয়াল ‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্যা চরস (এমফোরসি)’ প্রকল্প সম্পর্কে তুলে ধরেন। মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অর্থবিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ আজাদ সাল্লাল এবং প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক, আইএডিএস।
তবে এই সেমিনারের একটি বিশেষত্ব ছিল বিভিন্ন চর থেকে আসা চরের মানুষ। যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার পূর্ব-ধনিরাম চরের কৃষাণী সানজিদা আক্তার হীরা, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার খোলাবাড়ি চরের কৃষক সোনা মিয়া, গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার দেলুয়াবাড়ি চরের উদ্যোক্তা মশিরন বেগম এবং গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ভাষারপাড়া চরের নার্সারি উদ্যোক্তা সুফল চন্দ্র। সেমিনারে দুই প্রতিমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে তারা বলছিলেন তাদের চর জীবনের লড়াই-সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার গল্প, এগিয়ে যাওয়ার গল্প। উল্লিখিতরা একসময় ছিলেন একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত, বঞ্চিত। কিন্তু সুইস কন্ট্যাক্ট-এর ‘মেকিং মাকের্ট ওয়ার্ক ফর দ্যা চরস’ (এমফোরসি)-এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়ে তারা সবাই নিজের জীবনে ধারাবাহিকভাবে কিছুটা হলে আত্মবিশ্বাস আর স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পেরেছেন। কিন্তু চরের মানুষ হিসেবে তারা আরও সহযোগিতা চান। তারা চরে সরকারের আরও পরিকল্পনা ভিত্তিক উন্নয়ন দেখতে চান। তাদের আফসোসের শেষ নেই। তারা বলেন, চরে যে জনসম্পদ আছে সেই সম্পদের দিকে সরকারের আলাদা নজর দিতে হবে, তাদের সার্বিক উন্নয়নে আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে। চরের মানুষের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। তারা বলেন, চরে শুধু বন্যা, নদী ভাঙ্গনই বড় সমস্যা নয়। এসব সমস্যার ভীড়ে আরও অনেক ছোট ছোট সমস্যা রয়েছে। সেই সব সমস্যার দিকে নজর দিতে হেব।

জামালপুরে চরাঞ্চলের কৃষক সোনা মিয়া বলছিলেন, ‘চরের কৃষাণ ও কৃষাণীদের একটি বড় সমস্যা চরে ফসল সংরক্ষণের জন্য কোনো সংরক্ষণাগার নেই। চরের কৃষকেরা তাই কোথায় ফসল রাখবে? এ নিয়ে বিষয় বিশেষজ্ঞ, নীতি-নির্ধারক আর সেবাদাতাদের ভাবতে হবে। সরেজমিনে গিয়ে দেখে এই সব সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
আবার গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার দেলুয়াবাড়ি চরের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মশিরন বেগম বলেছিলেন, চরে মুরগি ও গরু পালন করে আমরা জীবনযাপন করি। এমফোরসি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই প্রকল্প পাশে না দাঁড়ালে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো। আমাদের জীবনে এত দ্রুত পরিবর্তন আসতো না। কিন্তু আমাদের জন্য আরও সহায়তা দরকার।
গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ভাষারপাড়াচরের তরুণ উদ্যোক্তা সুফল চন্দ্র। তার মতে, ‘চরে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা কাজ করতে পারি, খাটতে পারি। আমাদের প্রয়োজন বুদ্ধি আর আর্থিক সহায়তা। এ দুটি পেলে আমরা আরও ঘুরে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু আমাদের উন্নয়নে নীতি-নির্ধারকরা খুব একটা ভাবেন বলে মনে হয় না। আমাদের নিয়ে তাই সুনির্দিষ্ট ভাবে ভাবতে হবে। আমাদেরকে শক্তিশালী সম্পদে পরিণত করতে হবে। আমাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য নতুন পথের সূচনা করতে হবে।
চরের মানুষ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তিনি বরাবরই সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেন। নীতি-নির্ধারকদের কাছে আহ্বান জানান। ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘চরাঞ্চলের অমিত সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সকল অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। একইসঙ্গে চরবাসীর চাহিদাগুলোকে সামনে আনার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে যাতে করে বাস্তবভিত্তিক ও সময়োচিত উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায়।’ তার কথার ভার ও গুরুত্ব অনেক।
আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের একটি বড় অংশ চরভূমি হিসেবে পরিচিত। মূলভূমির সাথে যুক্ত চর, দ্বীপচর, উপকূলীয় চর, অস্থায়ী চর- সব মিলিয়ে এসব চরে প্রায় ১ কোটি মানুষ বসবাস করে। বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি। দেশের প্রায় ৩২টি জেলার ১০০ উপজেলার অংশবিশেষ জুড়ে বিস্তৃত এই চরাঞ্চল।
তীব্র নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মৌসুমী বেকারত্ব এসব মোকাবিলা করেই বছরের প্রায় পুরো সময়টা ধরেই চরের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে। এ বছর বন্যায়ও চরের মানুষ ফসলি জমি, ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ হারিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ ঝুঁকির দেশে পরিণত করেছে। নদীবাহিত এদেশের চরাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী এই দুর্যোগের প্রথম ও প্রধান শিকার। দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর বসবাস চরাঞ্চলে। প্রতিবছরই চরের মানুষকে তাদের সম্পদ হারাতে হচ্ছে বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে না হয় জীবন ধারণের প্রাত্যহিক চাহিদা মেটাতে।
চরে বসবাসরত মানুষগুলো জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না। খাদ্যাভাব পূরণ করাই তাদের কাছে প্রধান চিন্তার বিষয়। এছাড়া কৃষি সেবা, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা সেবাসহ অপরাপর সরকারি সেবাসমূহ এখনও তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম হওয়ায় সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সেবা ও সহযোগিতা চর এলাকায় ঠিকমত পৌঁছায় না। যেটুকু যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্যও বটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বৃহত্তর চরভূমি এক বিশাল সম্ভাবনার জায়গা। আমাদের দুর্দিনে আগামীদিনের খাদ্য নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার উৎসভূমিতে রূপান্তর করা সম্ভব দেশের শত সম্ভাবনাময় চরাঞ্চলকে। চরে রয়েছে প্রচুর পলিযুক্ত উর্বর কৃষি জমি। জমিগুলো চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের উপস্থিতিও (কিষাণ-কিষাণী) রয়েছে। চরাঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় এবং কৃষকদের স্বউদ্যোগে কৃষি বিপ্লবের নতুন নতুন সংবাদ দারুণ আশার সঞ্চার করছে। তিস্তা চরের বালুতে বিশেষ পদ্ধতিতে কুমড়া উৎপাদন পদ্ধতি বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে। এ ছাড়া মরিচ, বাদাম, স্কোয়াশসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত চরভূমি। বিশেষজ্ঞদের মতে, চরাঞ্চল অর্গানিক সবজি উৎপাদনের একটি অন্যতম ভান্ডার। ভেষজ চাষও চরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধরনের ডাল ও সবজি আবাদেও মাধ্যমে দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণে চরাঞ্চলকে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।
গবাদি পশুপালন এবং দুধের চাহিদা পূরণেও সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জায়গা এখন চরাঞ্চল। পদ্মা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র বক্ষের চরগুলোতে এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগির খামার গড়ে উঠেছে। এসব কার্যক্রম থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে চরের দরিদ্র মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জাতীয় সংসদে তার এক বক্তৃতায় চরের উন্নয়নে নীতি ও কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০১৭ সালের ৭ জুন জাতীয় সংসদে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে তিনি বলেছিলেনন, বর্তমান সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ভিশন ২০২০-২০২১ বাস্তবায়নে চরাঞ্চলের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তনে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও এই সব এলাকা উন্নয়নের লক্ষ্যে নীতি ও কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। যথা: ক) চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তহবিল গঠন; খ)অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরিতে প্রাধান্য দেয়া; গ) চরাঞ্চল অঞ্চলসমূহে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর সুযোগ তৈরি করা; ঘ) চরের খাস জমির বিতরণ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করা; ঙ) চরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ সেবা বৃদ্ধি করা; চ) চরাঞ্চল অঞ্চলসমূহের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা; ছ)প্রতিকূল জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তনের আঘাতের বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতা তৈরিকরণ: জ) টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণে চরাঞ্চল সুরক্ষার জন্য সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা।
আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত এই নীতি-কৌশল বাস্তবায়িত হোক। কিন্তু চরের মানুষের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন নীতি চোখে পড়ছে না। ১৬ মে ২০২৩ সিরডাপ সেমিনারে ‘চরাঞ্চলের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা: চরের জন্য জাতীয় বাজেট’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। অনেকেই সুন্দও সুন্দর প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এই আলোচনা আরও হওয়া দরকার। চর থেকে আসা কৃষাণী সানজিদা-মশিরণ, কৃষক সুফল-সোনা তাদের কথাগুলোর মমার্থ, ভাষা আমাদের উপলব্দিতে আনতে হবে। একই সাথে জরুরি প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত চরের উন্নয়নে যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা সেটার যথার্থ বাস্তবায়ন করা। আর সেটা বাস্তবায়নে বাজেটে চরের মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দও জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)