ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে সুদর্শন নায়কদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আজিম। ষাটের দশকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এই চিত্রনায়ক। হারানো দিন, নতুন সুর, মেঘ ভাঙ্গা রোদ, ডাকবাবু, সাইফুল মুলক বদিউজ্জামান, সাত ভাই চম্পা, ভানুমতি’র মতো অসংখ্য হিট ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি।
সিনেমা অন্তপ্রাণ এই নায়কের হাত ধরে বেশ কয়েকজন চিত্রনির্মাতারও অভিষেক ঘটে এই অঙ্গনে। পরবর্তীতে যারা সফল হয়েছেন। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়, একাধারে প্রযোজনা ও পরিচালনাতেও নিজের দক্ষতা দেখিয়েছিলেন আজিম। সিনেমা নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন, তার এই গল্পগুলো তাদের অজানা নয়।
তবে সিনেমার বাইরেও অনন্য এক আজিমের গল্প শোনালেন তার স্ত্রী ও ‘রূপবান’ খ্যাত অভিনেত্রী সুজাতা। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ মারা যান অভিনেতা আজিম (নূরুল আজিম খালেদ রউফ)। বরেণ্য এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী রবিবার (২৬ মার্চ)। মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে অভিনেত্রী সুজাতা চ্যানেল আই অনলাইনকে শোনালেন চেনা আজিমের অজানা গল্প!
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করেও ১৯৭১ সালে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন আজিম, জীবনসঙ্গী হিসেবে তা খুব কাছ থেকে দেখেছেন সুজাতা। যুদ্ধ দিনের সেইসব ভয়াবহ দিনে জান বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন আজিম, সেইসব দৃশ্য আজও সুজাতার চোখে অমলিন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে সুজাতাকে দেয়া উপহারের গাড়িটিও সেসময় বিক্রি করে দিয়েছিলেন আজিম। সেইসব মুহূর্তগুলো এখনও চোখ বুজলে সুজাতার স্মৃতিতে ভেসে উঠে! সেই সময় পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে ধরাও পড়েছিলেন আজিম। জেলে থেকে প্রায় দুই মাস নির্যাতন সহ্য করেছেন। সেই দুঃসময়ে স্বামীকে মুক্ত করতে সুজাতার ছুটোছুটি, আজও স্মৃতিতে জলজল তার!
স্বামী ও অভিনেতা আজিমের মৃত্যুদিনে সুজাতার সেইসব স্মৃতিকথা থাকলো চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য:
আজিম ছিলেন অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করা যোদ্ধাদের চরম সময়ের বন্ধু। জীবন বাজি রেখে আজিম নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাই বলতেই পারি,আজিম একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালে ২ হাত বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। উনি মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করতেন কিছু উদাহরণ দেই। আমাদের ১৯৬৭ সালে বিয়ে হয়। ১৯৭১ সাল চলে আসে। সারাদেশে যুদ্ধ চলছে। শাশুড়ির কথায় আমাকে একটি গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। তখন গাড়িটির দাম ছিল ২৫ হাজার টাকা। একমাস আগে কিনে দেওয়া নতুন গাড়িটি ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে আজিম সবগুলো টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেন। আমাকে বলেছিলেন, সবার আগে প্রয়োজন দেশ, গাড়ি বেঁচে থাকলে কেনা যাবে। তখন তো শুটিং বন্ধ ছিল। যুদ্ধ চলছে। হাতে তো ওভাবে টাকা ছিল না। যেভাবে সম্ভব হয়েছে আজিম টাকা জোগাড় করে দিতেন। একদিন এক মুরগিওয়ালা এসেছেন। তার কাছ থেকে দুটো মুরগি নিলো আর অনেকগুলো টাকা দিল। আমার চোখে পড়লো। বললাম,এতগুলো টাকা দিলে আর দুটো মুরগি নিলে! উনি আমাকে ডেকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো,আস্তে কথা বলো। উনি মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা নানা ছদ্ববেশে আসতেন, আজিম ওনাদের কী সাহায্য করবেন জোগাড় করে রাখতেন। আমি বই লিখেছি ‘শিমুলির একাত্তর’। সেখানেও এই কথাগুলো আছে। আরও বিস্তারিত আছে। মুক্তিযোদ্ধারা এখনো বেঁচে আছেন। আজিমের এই অবদানগুলোর কথা যদি জিজ্ঞেস করা হয়, উনারা সম্মানভরে স্মরণ করবেন। এখনো বেঁচে আছেন সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন মায়া। উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। উনি জানেন আজিমের অবদান। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর ছোট ভাই ফতেহ আলীও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ওই মুরগিওয়ালা হয়ে উনিই এসেছিলেন। ওনারা এখনো বেঁচে আছেন, সাক্ষ্য দেবেন আজিম সাহেবের অবদান। এমন অনেকে আছেন যাদের হয়তো তখন আমি চিনে উঠতে পারিনি। উনি এগুলো কারো কাছে বলতেনও না। কত যে হিন্দু পরিবারকে নিজের খরচে ভারতে পাঠিয়েছেন। অভিনেত্রী সুমিতা দি থাকতেন এফডিসির ফ্লোরে,তাকে সাহায্য করতেন। চিত্রপরিচালক প্রদীপ দে এখনো বেঁচে আছেন- উনিও জানেন আজিম সাহেবের অবদান। যেগুলো মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশ্যে এসে কিনতে পারতেন না। আমরা কুপি, তেল, ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে যা পারতাম বাইরে থেকে সংগ্রহ করে ওনাদের জন্য রেখে দিতাম। কত যে হিন্দু পরিবারকে নিজের খরচে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি তো হিন্দু ছিলাম। আমার পরিবারকেও ভারতে নিজের খরচে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হিন্দু পরিবারের থাকা, খাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ সাহায্য করেছেন। এগুলো একটা সময় পাক সেনারা খবর পায়। ওনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কোনোভাবে জানলাম পাকিস্তানি কর্নেল মুমতাজ নামে একজন আছেন, উনি একটু সৎ। উনি হয়তো আজিমকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। তখন আমি সাহস নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে গেলাম। কিন্তু কয়েকদিন ঘুরেও ওনার কোনো খোঁজ পাই না। একদিন মুমতাজের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো। ওনার কাছে আমার ও আজিমের পরিচয় দিলাম। তখন তো আমরা দুজনেই ছবি করেছি। ওনার পা চেপে ধরে অনুরোধ করলাম যে আজিমকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। উনি উর্দুতে আমাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘আচ্ছা কী করা যায় আমি দেখছি।’ পরেরদিন আমি আবার গেলাম। অনেক অপেক্ষার পর মুমতাজ এসে বললেন, উনি বেঁচে আছেন। আপনাকে টেলিফোনে কথা বলিয়ে দিচ্ছি। আজিম সাহেব ফোনে আমাকে কেঁদে বললেন ‘ওরা মনে হয় আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে অত্যাচার করছে।’ আমি মুমতাজকে বললাম ওনাকে তো মেরে ফেলা হবে। উনি বললেন দেখছি কী করা যায়। ওনার স্ত্রী হয়তো ওনাকে কনভিন্স করে আজিমের মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। তাও প্রায় দেড় মাস পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছোট্ট একটি রুম থেকে ৫২ জন একসঙ্গে বের হয়েছিলেন! অনেকের অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল নির্যাতিত হয়ে। বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে আজিম আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে শুরু করেন। তার বক্তব্য ছিল, দেশ স্বাধীন করতেই হবে। এরপর ধরা পড়লে হয়তো ওনাকে আর বাঁচানো যেত না। আমারও যে কতদিন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। আমি নাটক বন্ধ করে দিলাম। লাল কালি দিয়ে আমাকে চিঠি দেওয়া হলো। তুমি যদি নাটক না করো তোমাদের বাসায় বোম মারা হবে। এরপর আমরাও কলকাতায় চলে গিয়েছিলাম।
স্বাধীনতার পরে আমরা আবার শুটিং শুরু করলাম। কয়েকজন স্বনামধন্য পরিচালকও এফডিসিকে আজিম উপহার দিয়েছেন। যেমন ইয়ার খান, আকবর কবির পিন্টু, আকবর হুদা মিন্টুকে পরিচালক বানিয়েছেন। জসিম ওনার হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছেন। জসিমের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির প্রায় সমস্ত ব্যয় উনি করেছিলেন। জসিম শুধু ১০ হাজার টাকা খরচ করেছিল। তখন এত ট্রান্সপোর্ট ছিল না। উনি নিজের গাড়ি দিয়ে শুটিংয়ের পর শিল্পী কলাকুশলীদের পৌঁছে দিতেন। একজন লাইটম্যান হয়তো অসুস্থ হয়েছেন, নিজের খরচে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন। কেউ হয়তো বলছে তার পরিবার চালাতে পারছে না কাজ করে, বিদেশ যেতে চাচ্ছে,তাকে টাকা পয়সাসহ সবরকম ব্যবস্থা করে দিতেন। আমাদের ঘরটা ছিল সবার আশ্রয়স্থল। পারিবারিকভাবে আজিম ছিলেন খুবই ধনী ঘরের সন্তান। তখন আজিম শুটিংয়ে যেতেন ব্যক্তিগত গাড়িতে করে। শুটিং স্পটে কম মানুষই তখন ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতেন। আজিম ছিলেন উদার মনের মানুষ। তার মতো উদার ও বড় মনের মানুষ এ জীবনে কমই দেখেছি। এটা শুধু আমি নই, সেই সময়ের অনেকেই জানতেন। সিনিয়র অনেকেই বেঁচে আছেন। তারা বলবেন আজিমের কথা। ঝন্টু বেঁচে আছে, সে জানে এসব ইতিহাস। আজিমের কাছে কিছু চেয়ে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফেরেননি। এতোটাই উদার মনের ছিলেন তিনি।
চলচ্চিত্রে আজিমের পরিচয় শুধু অভিনয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক,পরিবেশক, হল মালিক হয়ে উঠেন। নিজেই শুধু ছবি প্রযোজনা করেন নি,অন্যদেরও উৎসাহ দিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, নিজে অভিনয় করেছেন, সংশ্লিষ্ট থেকেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। অনেকে হয়তো এসে বলতেন, আজিম ভাই ওর ছবিটা আমি করতে চাই। আপনি না করলে আমি করতে পারতাম। উনি সাথে সাথে তার কাজ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। স্নেহ করতেন। সব সময় হাসিমুখ। প্রতিটি কথায় ছিলো রসবোধের ছোঁয়া। এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অন্যতম একজন কারিগর। তার অভিনীত ‘হারানো দিন’, ‘নতুন সুর’,‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ’,‘ডাকবাবু’,‘সাইফুল মুলক বদিউজ্জামান’, ‘সাত ভাই চম্পা’,‘ভানুমতি’ চলচ্চিত্রগুলো যেমন রয়েছে, তেমনি তার পরিচালিত ‘টাকার খেলা’,‘প্রতিনিধি’,‘জীবন মরণ’,‘বদলা’,‘গাদ্দার’,‘দেবর ভাবী’ বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। ‘মালা’, ‘ডাকবাব’, ‘আমির সওদাগর’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’, ‘মধুমালা’,‘রাখাল বন্ধু’ প্রভৃতি ছবিতে আমার নায়ক ছিলেন আজিম।
আজিম (নূরুল আজিম খালেদ রউফ) ১৯৩৭ সালের ২৩ জুলাই সিলেটের হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন মুন্সেফ। তাই আজিমের শৈশব-কৈশোর কাটে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পরবর্তীতে ঢাকার হাটখোলার ভবগতী ব্যানার্জী রোডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
তাকে হারিয়ে এই ২০ বছরে শুধু একটি কথাই বারবার মনের মধ্যে উচ্চারিত হয়, আজিমের একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও কি প্রাপ্য নয়! আজিমের মুক্তিযুদ্ধ পরিচয়কে রাষ্ট্র এত বছরেও স্বীকৃতি দিতে পারল না! এটা নিয়ে আমার কারো প্রতি আক্ষেপ নেই, চরম দুঃখবোধ আছে। আমার এক ছেলে ফয়সাল আজিম, পুত্র বধু, দুই নাতি- এদের নিয়ে জীবনযাপন। জানিনা আমি কতদিন বাঁচবো, আমার বয়সও তো কম হলো না। নিজেতো অনেক পেয়েছি। এই সরকার আমাকে একুশে পদক দিয়েছে, চলচ্চিত্রে অবদানের কারণে আজীবন সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু আজিমের কথা ভাবলে কখনও কখনও পীড়ন অনুভব করি। এই দুঃখবোধ নিয়েই কি মরতে হবে! আজিম যদি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পেতেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতেন- হয়তো স্ত্রী হিসাবে শান্তিতে মরতে পারতাম। আমার সন্তান নাতিরা গর্ব নিয়ে বাঁচতে পারতো।