কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়: ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত’। সত্যিই আজ বসন্ত? হ্যাঁ, সত্যিই আজ পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা আজ সত্যি হলো- ‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়, ফুল ফুটেছে বনে বনে, শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায় ফাল্গুনী মোর মন বনে।’
শীতের রিক্ততা ভুলিয়ে আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফাগুনের ছোঁয়া, রঙে রঙ্গিন প্রকৃতি। গাছে গাছে ফুটেছে রক্ত শিমুল-পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম। লাল-হলুদ-সাদা আর বেগুনি। চমৎকার, কত রঙিন! অন্যরকম এক আবেশ ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। বাহারি সাজে আপন রূপে সেজেছে সে।
দালান-কোটার এ-শহরের অলিতে-গলিতে, রাস্তার পাশে, শখের বসে গড়ে তোলা শিশুর ছাদ বাগানে, গাছে গাছে চিক চিক করছে সবুজ কচিপাতা। ঝিরি ঝিরি বাতাসে সবুজ পাতা তিরতির করে উড়ছে। এদিক সেদিক প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। কোকিলের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় পথিক। কবি তার কবিতা বুনে। প্রকৃতিপ্রেমী বসন্ত বন্দনা করছে তার আপন মনে।
বসন্তের এই রূপ-সৌন্দর্য্য শহরবাসীর মনে দিয়েছে দোলা। কারণ, একদিকে পহেলা ফাল্গুন অন্যদিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আজকের এই দিনে তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ তার প্রিয়জনকে ফুল দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করেন। ফুলেল পরিবেশে হচ্ছে বসন্ত বরণের নানা অনুষ্ঠান। রাজধানীর বুকে আয়োজিত হয় ফুলের মেলা ও বসন্তের পিঠা উৎসব।
ভালোবাসা আর বসন্ত মিলে আজ উৎসবে মাতোয়ারা পুরো দেশ। আজ তরুণ-তরুণীরা নামবে, বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলের রঙে সাঁজতে। তরুণীরা পরছে বাসন্তী রঙের শাড়ি। খোঁপায় ফুল গুঁজে হাতে পরে কাঁচের চুড়ি। তরুণরাও বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি-ফতুয়া পরে নামে বাংলার পথে ঘাটে। আর রাজধানী ঢাকার বুকে বাসন্তী সাজে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর, চারুকলা আর টিএসসি, রমনা পার্ক, জাতীয় সংসদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, লেকের পাড়, শান্তিনিকেতন, মহুয়া তলা, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন ইত্যাদি জায়গায়।
তারা বসন্ত উন্মাদনায় আজকে মেতে উঠে, শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলছে ধুম আয়োজন। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসছে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরাজীর্ণতা। তখন সত্যিই হবে সুফিয়া কামালের কথা, কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী, গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে রিক্ত হস্তে।
শুধু শহরেই নয়, বাংলার গ্রামীণ জনপদেও আজ ঝিরি ঝিরি বাতাসে ধরা দেবে বসন্ত। বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলার সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের মানুষ মেলা, সার্কাসসহ নানা বাঙালি আয়োজনে মেতে উঠে।
বসন্তের প্রথম দিনকে অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুনকে বাঙালি পালন করে ‘বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। এ উৎসবটির পেছনে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। মোঘল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষের সূচনা করে করেন ১৫৮৫ সালে। নববর্ষকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম ও উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই বসন্ত উৎসব শুধু একটা উৎসব নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে বাঙ্গালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সংস্কৃতি।
এ বসন্ত শুধু উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার রঙ ছড়ায় না, এটি আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তরঙিন স্মৃতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন, একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ারও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তাইতো বসন্তের রক্তিমা বাঙালির শিরা-ধমনী-অস্তিমজ্জায় বহমান। বাঙালির জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বসন্ত। তাই আমরা স্বপ্ন দেখি বসন্তের বন্দনা শুধু কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় নয়, দেশমাতৃকার সংকটে জেগে উঠবে বারংবার। তখনই হয়তো স্বার্থক হবে বসন্তের ভালোবাসা।