এশিয়ানরা আশায় বুক বেঁধে থাকলেও জাপান এবং সাউথ কোরিয়া দুদলের কারো পক্ষেই শেষ ষোলো টপকানো সম্ভব হয়নি। সাউথ কোরিয়া যে নন্দিত ব্রাজিলের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না এটি অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। মধ্যরাতে হয়েছেও তাই, ব্রাজিল হেসেখেলে ৪-১ গোলের বড় ব্যবধানে সাউথ কোরিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফির দিকে ছুটে চলেছে।
কিন্তু জাপানের জন্য সবার ভীষণ মন খারাপ। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল জাপানের। ১২০ মিনিট সমানতালে লড়াই করেও শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা আর অতিরিক্ত নার্ভাসনেস-এর কারণে জাপানকে টাইব্রেকারে বিদায় নিতে হয়েছে। নইলে জাপান সত্যিই এক নতুন ইতিহাসে পা রাখতে পারতো।
জাপান বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলেও সুন্দর, লড়াকু ফুটবল উপহার দিয়ে সবার মন জয় করে গেছে। গতকাল ক্রোয়েশিয়ার সাথে ম্যাচে শুরুতেই জাপান ছিল অদম্য, সাহসী এবং সংগ্রামমুখর। আর তাইতো ৪৩ মিনিটে দায়েন মায়েদা গোল করে এগিয়ে দিয়েছিলেন জাপানকে। কিন্তু গত বিশ্বকাপের রানার্সআপ দল ক্রোয়েশিয়াকে গোল পরিশোধে বেশি সময় নিতে হয়নি। ৫৫ মিনিটে ক্রোয়েশিয়ার ইভান পেরিচিস দুর্দান্ত এক হেডে গোল পরিশোধ করেন। এরপর দুদলের মধ্যেই ছিল লড়াই আর পাল্টা লড়াই-এর উন্মাদনা। কিন্তু শেষপর্যন্ত গোল হয়নি খেলার অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত।
শেষমেষ টাইব্রেকারে জয়লাভ করে ক্রোয়েশিয়া। পেনাল্টি শুট আউটে জাপানের ফুটবলারদের স্নায়ুশক্তির সীমাবদ্ধতা বোঝা যায় খুব ভালোভাবে। জাপান হেরে গেলেও এশিয়ানদের মন যে জয় করতে পেরেছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই বিশ্বকাপে এশিয়ানদের গল্প শেষ। তবে এশিয়ার দুই টিমের কাছে বড় তৃপ্তি হয়ে থাকবে বিশ্বসেরাদের হারানোর গল্পগুলো।
জাপান এবং সাউথ কোরিয়ার সাথে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে সাবেক তারকা ফুটবলার, দীর্ঘদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলা কাজী কামালের। আশির দশকে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলের লেফট ব্যাক হিসেবে প্রতিপক্ষকে সামলান তিনি। ঘরোয়া লিগে খেলেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং আবাহনী ক্রীড়া চক্রে (বর্তমানে আবাহনী লি.)। রাজধানীর কলাবাগানে বাসা। এশিয়ার দুটি দেশ জাপান ও সাউথ কোরিয়ার পারফরম্যান্সে অনেকের মতো কাজী কামালও খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন জাপান কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে এসে নতুন এক ইতিহাস উন্মোচন করুক।
বেদনার্ত হৃদয়ে বললেন, ‘শক্তিশালী জার্মানি ও স্পেনকে হারানোর পর প্রত্যাশা করেছিলাম ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে আমাদের এই বন্ধুপ্রতীম দেশ ফুটবলের আরও উচ্চতায় অবস্থান করুক। কিন্তু সেটা আর হল না। জাপান শুরু থেকেই খুবই ভালো খেলে আসছিল। ১২০ মিনিট লড়াই করেছে একটানা। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে টাইব্রেকারে হারতে হল। বিপরীতে বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার টাইব্রেকারে জেতার অভিজ্ঞতা ছিল বলেই তারা ৩-১ গোলে জয়লাভ করতে পেরেছে। এটিও জাপানের জন্য শিক্ষণীয়। আগামীতে প্রত্যাশা করি জাপান ফুটবলে আরও পরিপূর্ণতা লাভ করবে। জাপান সত্যিই আমাদের সবার হৃদয় জয় করেছে, হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। জাপানের জন্য কষ্টও হচ্ছে সবার।’
আজ বিশ্বকাপের দুটি খেলার মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলার সমাপ্তি হবে। প্রথম খেলায় মুখোমুখি হবে মরক্কো এবং স্পেন। দ্বিতীয় খেলায় লড়বে পর্তুগাল এবং সুইজারল্যান্ড। প্রথম ম্যাচের দিকে সবার নজর একটু বেশিই। কেননা লড়াই হবে বাঘে-মহিষে। অনেকেই মনে করছেন আজ ২০১০ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের বিদায়ঘণ্টা বাজতে পারে। মরক্কো মাতিয়ে ফেলতে পারে এবারের বিশ্বকাপ।
এরকম ভাবার মূল কারণ মরক্কোর ধারাবাহিক ফাইটিং স্পিরিট। গ্রুপ পর্বের খেলায় মরক্কো ক্রোয়েশিয়ার সাথে ড্র এবং বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে হারিয়ে যে শক্তি প্রদর্শন করে, সেটা দিয়েই সবাই আজকের ম্যাচে মরক্কোকে ফেভারিট হিসেবে দেখছে। মরক্কোর উইং ব্যাক আশরাফ হাকিমি বলেছেন, অঘটনের জন্ম দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। আর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগি বলেছেন, বিশ্বকাপ জয়ের জন্য তারা এসেছেন। সহজে এই পথ থেকে সরতে চান না। আজ তাই জয়ের বাইরে তারা কিছুই দেখছেন না। এখানেই শেষ নয়, এমন কী স্পেনের কোনো কথা তারা কানে নিতে চান না।
দেশের সাবেক তারকা ফুটবলার কাজী কামালও আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ নিয়ে মহা সন্দিহান। তার মতে, ‘প্রথমত আজকের এই ম্যাচটি রীতিমতো যুদ্ধ। ম্যাচটি হবে তাই খুবই ঘটনাবহুল। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণে ঠাঁসা থাকবে। দুদলই সমান তালে লড়বে। মরক্কোর যে স্পিরিট সেখানে স্নায়ুযুদ্ধে সামান্য হলেও পিছিয়ে থাকবে স্পেন। মরক্কোর সবচেয়ে পজিটিভ দিক হল জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে তারা লড়বে। আর অনুপ্রেরণা হিসেবে রয়েছে প্রথম পর্বে বেলজিয়াম ও কানাডাকে হারানোর মধুর স্মৃতি। মাঠে মরক্কোর আধিপত্য খর্ব করা তাই কঠিন হবে। তবে সবমিলিয়ে একটি প্রাণবন্ত লড়াই সবাই দেখতে পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফুটবল গোলের খেলা। গোল না হলে ফুটবলে মজাটা নষ্ট হয়ে যায়। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে সেই মজা থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না। আর আমার প্রত্যাশা ম্যাচ যেহেতু একতরফা হওয়ার সুযোগ নেই সেহেতু এই ম্যাচের মূল সৌন্দর্য হবে আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ। ম্যাচটা হবে আনন্দপূর্ণ এবং শেষ বাঁশি পর্যন্ত কী হবে বলা যাবে না। তবে স্পেনও যথেষ্ট ক্যালকুলেটিভ দল। কিন্তু মরক্কোর সংঘবদ্ধ লড়াই-এর বিপক্ষে তারা কী করে সেটা দেখার বিষয়। মরক্কো জিতলে আগামীতে এই দলের সামনে যারা পড়বে তাদেরও টেকা দায় হয়ে পড়বে।’
দ্বিতীয় ম্যাচ নিয়ে কাজী কামাল বলেন, ‘এই ম্যাচে ফেভারিট নিঃসন্দেহে পর্তুগাল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামে ওদের একজন মাস্টার প্লেয়ার রয়েছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের অভিজ্ঞতাও কম না। আজ রোনালদোর দিন হলে ক্ষতি নেই। আজ পর্তুগাল একটু অন্য মুডে খেলবে। পর্তুগাল জয়ী হলে দর্শকদের জন্য বিশ্বকাপ আরও আনন্দময় হবে।’