বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অন্যতম প্রধান সৈনিক শেখ ফজলুল হক মণি তার বিরোধী রাজনীতিকদের বেলায়ও সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিতেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য খুবই তীক্ষ্ণ হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিংবা তাদের কষ্ট-দুর্দশার বিষয় মাথায় রেখে সহযোগিতা করতে কখনোই কার্পণ্য করতেন না তিনি।
সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হাতে ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে নিহত হওয়ার কয়েকমাস আগের এমনই এক চিত্র উঠে এসেছে সেসময়ের বাম রাজনীতিবিদ ও পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের ‘আমার রাজনীতির ৬০ বছর: জোয়ার-ভাটার কথন’ বইয়ে।
কাজী জাফর লিখেছেন: “আকস্মিকভাবে শেখ ফজলুল হক মণির সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে আমরা একে অপরের বিপরীত অবস্থানে থাকলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা ঠিকই বজায় ছিল। তার সাথে দেখা হওয়ার পর সে বলল, তোমার সাথে আমার কথা আছে, আমি বললাম, ঠিক আছে বলো, কী কথা আছে?
সে বলল, চলো মামার (বঙ্গবন্ধু) সাথে এখুনি দেখা করব।
আমি বললাম, তোমার মামা হলেন দেশের রাজা। আমরা হলাম তার প্রজা। আমরা কীভাবে তার সাথে দেখ করব? তুমি তোমার মামাকে বলো, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব শ্রদ্ধা করি।
আমার কথা শুনে শেখ মণি আমার ওপর একটু খেপলো। তারপর বলল, তোমার যুক্তির সারবত্তা আছে। যা-ই হোক আমি দেখব, কথা বলব। এখন কী করবে ঠিক করেছ?
আমি বললাম, কী করব জানি না।”
এরপর শেখ মণি কাজী জাফর আহমদকে বাকশাল গঠনের বিষয়ে বললেন এবং সেখানে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। যদিও কাজী জাফর আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাকশালের বিরোধিতাকারী একজন বামপন্থী নেতা। এমনকি বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য বামপন্থী নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি নিজ দল থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। পরবর্তীতে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) নামে একটি রাজনৈতিক দলও করেন তিনি।
কাজী জাফর আহমদ লিখেছেন: “এরপর সে বলল, এ আলোচনা থাক, তুই একটা কথা বল, আমরা যে চিন্তাভাবনা করেছি তার সাথে আছিস কিনা?
আমি বললাম, তুই তো বললি এখন, আমাকে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে না? আমি তো একা না। আমাদের দল আছে। সবার সাথে আলোচনা করতে হবে।
সে বলল, আর চিন্তাভাবনা করার কথা বাদ দে। দেখবে কোনদিন তোমার লাশ রাস্তায় পড়ে থাকবে। আর আমাকে সে লাশ এনে দাফন-কাফন করতে হবে। এমনকি তোমার পরিবারকেও আমার চালাতে হবে।’’
কাজী জাফর স্বীকার করেছেন: আমি যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন দেখি, শেখ মণি আমাকে সেদিন যা বলেছিল তার বন্ধুত্বের দাবি আর আন্তরিকতা নিয়েই বলেছিল।
শেখ মণি বিরোধী রাজনীতিকদের সাথেও যেভাবে আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলতেন তাতে তারাও সরাসরি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারতেন না। সেই বিষয়টি কাজী জাফর তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘‘সেদিন আমি কিছুতেই আমার মনোভাব বুঝতে দেইনি। তার আন্তরিকতাকেও আমি প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইনি। শেখ মণি এরপর আমাকে যা বলল তা আমার কাছে ছিল খুব হৃদয়স্পর্শী। বলল, কোথায় থাকিস, কী খাস কী করিস, কোথায় ঘুমাস? তোদের এ সমস্ত জিনিস আমি বুঝি না। আমরা কখনো এ সমস্ত আন্ডারগ্রাউন্ডের জীবন বিশ্বাস করি না। আমরা জেলে যাওয়াটাই পছন্দ করি।’’
কাজী জাফর লিখেছেন: ‘‘তারপর সে বলল, তোর কাছে টাকা-পয়সা আছে? আমি বললাম, দিবি নাকি? সে বলল, দেখি, বলেই সে ঘরের মধ্যে চলে গেল। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, যা হয় রাজনীতিবিদদের জীবনে। তারা যা আছে তা সবসময় উজাড় করে দিতে চায়। কিন্তু তাদের স্ত্রীদের তো সংসার চালাতে হয়। শেখ মণি আলমারি খুলে এক মুঠো টাকা নিয়ে আমার কাছে এলো।
আমি তখন গাড়িতে উঠব। বললাম, কত?
সে বলল, আমি জানি না, তুই দেখ। আমি চিন্তা করে দেখলাম আমার তো টাকার প্রয়োজন নেই। নেয়াটা সঠিক হবে না। কিন্তু মণির যে আবেগ এবং আমার জন্য হৃদয় মিশ্রিত তার যে ভালোবাসা তাকে অপমান করা যায় না। তাই আমি টাকাটা নিলাম। গাড়িতে আমি গুণে দেখলাম টাকার পরিমাণ ৮ হাজার।’’
কাজী জাফর স্বীকার করেছেন: তখনকার রাজনীতিবিদদের চরিত্র, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আজকের রাজনীতিবিদদের মতো ছিল না। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য খুবই তীক্ষ্ণ ছিল; কিন্তু একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কের একটা অভিব্যক্তি সেদিন ঘটেছিল শেখ মণির সাথে আমার সাক্ষাতের মধ্যদিয়ে।
শেখ মণি সাংবাদিক হিসেবেও কতটা পেশাদার ছিলেন তার বর্ণনা উঠে এসেছে কাজী জাফর আহমদের লেখায়। নতুন রাজনৈতিক দল ইউপিপি গঠনের দিনের একটি ঘটনা তুলে ধরে কাজী জাফর লিখেছেন: ‘‘এই কমিটি গঠন করতে গিয়ে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছিল। তখন ‘বাংলার বাণী’ মোটামুটিভাবে একটা পাওয়ারফুল পত্রিকা ছিল। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিল শেখ ফজলুল হক মণি। ইউনাইটেড পিপলস পার্টির লক্ষ্য ও কর্মসূচি কী হবে এবং এর নেতৃত্বে কে আসবে এই নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচণ্ড কৌতুহল ছিল। তখন বাংলার বাণী পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন কামাল লোহানী। তার কাছ থেকে আমি শুনেছি শেখ মণি বারবার তার সম্পাদকের রুম থেকে বার্তা বিভাগে খবর নিচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে সংবাদ এলে সেটাই লিড নিউজ হবে। রাত ৯টার দিকে বাংলার বাণীর বার্তা বিভাগে ইউপিপির কাউন্সিলের রিপোর্ট আসে। শেখ মণি সাথে সাথে জানতে চান, নতুন পার্টির কী বক্তব্য এবং কী কমিটি হয়েছে। তাকে জানানো হয় ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী সভাপতি এবং কাজী জাফর আহমদ সাধারণ সম্পাদক। এ কথা শোনার পর তিনি রিপোর্টটি ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর আমার উদ্দেশে একটা গালি দিয়ে বললেন, এর মাথায় কিছুই নেই। কোত্থেকে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে ধরে এনে একটা নতুন পার্টির চেয়ারম্যান বানিয়ে দিলো। কাজী জাফর চেয়ারম্যান, রাশেদ খান মেনন সাধারণ সম্পাদক এটাই তো ভালো ছিল। তারপর তিনি বললেন, যা-ই হোক, যা হবার তা তো হয়ে গেছে, যদিও এটা ঠিক হয়নি। বাংলার বাণীতে নিউজটা হবে এ রকম, কাজী জাফরের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার অঙ্গীকার নিয়ে ইউনাইটেড পিপলস পার্টির যাত্রা শুরু, যদিও ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী পার্টির চেয়ারম্যান।’’