আজ বাংলাদেশের গণমানুষের ঠিকানা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন। তার জন্ম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক পরিবারে। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজা। সর্বংসহা নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার কন্যা। যার রক্ত-মজ্জা-শিরা-উপশিরা-ধমনিতে প্রবাহিত রাজনীতি। ১৯৮১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- আমি জন্ম থেকেই রাজনীতির মধ্যে আছি। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, আমাদের প্রিয় আপা শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা আজকে শুধু একটি নাম নয়, শুধুমাত্র একজন প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি একটি চেতনার নাম, একটি প্রত্যয়ের নাম, মানুষের অধিকার আদায়ের এক সংগ্রামী অভিযাত্রার নাম। তাকে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ, যে পথচলা কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিন না, এখনও নেই। শেখ হাসিনা সম্পর্কে যদি কিছু বলতে হয়, তাহলে অনিবার্যভাবে ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশে যে ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল, সেই পরিস্থিতির আলোকে বলতে হবে। যখন নেতৃত্বহীন ও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের অধিকারের কথা কথা বলার কেউ ছিল না, জাতি ছিল দিশেহারা, মুক্তির স্বপ্ন দেখানোর কেউ ছিল না, তখনই শেখ হাসিনা জাতির নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি অদম্য, তিনি অজেয় এবং অমর করে রাখবার মতো অগুণতি কর্ম তিনি করে চলেছেন। ইতিহাসের প্রয়োজনে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন এবং ইতিহাসের প্রয়োজন মিটিয়ে ইতিহাসের নতুন কালপর্বের উদ্বোধন ঘটিয়ে চলেছেন। এ আরেক সর্বংসহার জীবনালেখ্য! এটা কীভাবে সম্ভব?
আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, সন্তান গর্ভে থাকাকালে মাতা-পিতার ভাবনা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে ভূমিষ্ঠ সন্তানের ওপরে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে, শেখ হাসিনা যখন মাতৃগর্ভে তখন সারা বাংলা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় টলায়মান। যুক্তবাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খুলছেন, কর্মীদের পাঠাচ্ছেন তদারকি করতে। তরুণ নেতা শেখ মুজিবকেও বললেন দাঙ্গা উপদ্রুত বিহার অঞ্চলে যেতে। শেখ মুজিবেরও যাবার প্রবল আগ্রহ। কিন্তু শহীদ সাহেবই মনে করিয়ে দিলেন রেণুর শরীরটা ভালো না। ইতিপূর্বে প্রথম সন্তান হারিয়েছে, তাই এখন রেণুর পাশে থাকাও স্বামী হিসেবে শেখ মুজিবের জন্য জরুরি কর্তব্য। শহীদ সাহেব বললেন রেণুর সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নিতে। শেখ মুজিব যথারীতি স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলেন। উত্তরে রেণু লিখলেন ভয়ঙ্কর সুন্দর ও সম্মোহনী জাগানিয়া কয়েকটি কথা- “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লার ওপর আমার ভার ছেড়ে দেন।” এ চিঠি সম্পর্কে জেনে শহীদ সাহেব মন্তব্য করেছিলেন, “মুজিব, সে (রেণু) তোমার জন্য স্রষ্টার দেওয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাকে অবহেলা করো না।” তখন যে সন্তানটি রেণুর গর্ভে ছিলেন তিনিই শেখ হাসিনা। যার মা-বাবা এমনভাবে মানুষের জন্য চিন্তা করেন, তিনি মহান হবেন এতে বিস্ময় থাকলেও অস্বাভাবিকতা নেই। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা বইতে এটার উল্লেখ আছে।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার বয়স যতদিন তার প্রায় অর্ধেক সময় পিতা ছিলেন কারাগারে বন্দি। জন্মমুহূর্তে পিতা ছিলেন দূরে এবং পিতা-পরিজনের মৃত্যুকালে কন্যা ছিলেন দূরদেশে। কন্যার বিয়ের সময়ে পিতা ছিলেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত হয়ে কারাবন্দি। ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন, তখন তিনি কারাবন্দি ছিলেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন, তখন তিনি দেশ থেকে নির্বাসিত, অনেকটা বিদেশ-বন্দি! বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হন তখন বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বছর, তার কন্যাও যখন শীর্ষ পদে আসীন হন বয়স ছিল একই। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার সময় ও মানুষের মূলধারার প্রধান প্রতিনিধি, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও অর্থনৈতিক মুক্তির চেতনা নিয়ে রাজনীতি করেছেন, তার কন্যা যেন সেটাকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য’। এতেই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। সেই থেকে এদেশের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তির প্রধান নেতা ও মুখপত্র শেখ হাসিনা। পিতা ও কন্যার রাজনীতির পরম্পরা এখানে স্পষ্ট। অনেকটা একই আত্মা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুজন মানুষের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নানান দ্বৈরত ও হৃদ্যতায় ভরা পিতা-পুত্রী মানুষ দুটি আলাদা, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন।
বঙ্গবন্ধু যাত্রারম্ভ করেছিলেন নতুনভাবে এবং এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছেন। অপরদিকে তার কন্যা যাত্রারম্ভ করেছিলেন প্রায় অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া অবস্থান থেকে। বঙ্গবন্ধুর জীবনে পুরো পরিবার এবং স্বাধীনতার কারিগরদের হত্যার মতো নির্মম অতীত ছিল না, কিন্তু শেখ হাসিনাকে এরকম নির্মমতা মোকাবেলা করে পথ চলতে হয়েছে। পিতা ও পুত্রীর এই ব্যবধানটুকুর মাধ্যমে পুত্রীর অদম্য জীবনবোধের ভিন্ন একটি চিত্র পাওয়া যায়, যা অনন্য। তিনি প্রায় অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি দলকে পুনর্জীবিত করে, সেই দলের মাধ্যমে জনগণকে জাগিয়ে তুলে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিক্রিয়াশীল নীতি বদলে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সুষমবন্টন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেবার মাধ্যমেই শেখ হাসিনা ইতিহাসের অদ্বিতীয় অবস্থানে নিয়ে গেছেন। সম্ভবত এজন্যই আবদুল গাফফার চৌধুরী একবার লিখেছিলেন দেশের একমাত্র পুরুষ রাজনীতিক শেখ হাসিনা।
ইডেন কলেজের ভিপি হবার পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন শিক্ষক হবার বাসনার কথা। লেটস টকের একটু অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবার। কী অদ্ভুত সাযুজ্য! শিক্ষক ও চিকিৎসক দুটোর একটিও শুধুমাত্র পেশা নয়, এরচেয়ে বেশি কিছু, মূলত মানবসেবা। হয়েছেন রাজনীতিবিদ। ইতিহাস তাকে টেনে এনেছে রাজনীতিতে, ইতিহাসের প্রয়োজনে। ইতিহাস যেমন তাকে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি নিজেও ইতিহাস সৃষ্টি করে হয়েছেন ইতিহাসকন্যা।
অপপ্রচার ও মিথ্যাচার পিতার মতো কন্যাকেও পিছু ছাড়েনি। ১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই শুরু হয় নতুন উদ্যমে মিথ্যাচার, কুৎসা, অপ-প্রচার। পুরনো টার্গেট বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে এবার নতুন টার্গেট যোগ হয় শেখ হাসিনা। সেই থেকে শুরু। তখনই নবোদ্যমে এই অপপ্রচারের শুরু করেছিল বিএনপি নেতারা, ২০ ফেব্রুয়ারি রমনা গ্রিনে বিএনপির সভা থেকে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের উপস্থিতিতে রেলমন্ত্রী আবদুল আলীম, তেলমন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেন, সমবায় মন্ত্রী এ এস এম আবদুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ দিল্লির সেবাদাস, বাংলাদেশ বিক্রি করে দিবে, গোলামী চুক্তি করবে ইত্যাদি বলে গালমন্দ করে দলীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মিথ্যাচারের উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন। যা সে বছরেরই মার্চ মাসে সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি জেনারেল জিয়ার নির্দেশে শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলা, এনায়েতুল্লাহ খান মিন্টুর সাপ্তাহিক হলিডে এবং সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মহাসমারোহে কুৎসা রচনা শুরু হয়েছিল। ১৯৮১ সালের ২৬ এপ্রিল তারিখে কলকাতার দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা সকল সমালোচনার জবাব দিয়ে বলেছিলেন- ‘আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় আজ যারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ক্ষোভের শিকার হয়ে আজ যারা আমার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা রকম অপ-প্রচার চালাচ্ছে, সত্তর-একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা কী ছিল তা স্মরণ করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, এসব অপপ্রচারকারীরা কারা এবং তাদের ক্ষোভের কারণটাই বা কি’! নানারকম মিথ্যাচার, গুজব ও অপপ্রচারের মুখে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পথ চলা। এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পথ চলা।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৯১ সালের ৯ জুলাই সাপ্তাহিক সূর্যোদয় নামক এক পত্রিকায় এক অদ্ভুত ও ভিত্তিহীন নিউজ প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ছিল- ‘হাসিনা মুজিব হত্যার বিচার চায় না’। আর বিচার যখন হলো তখন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলে ফেললেন- খুনিদের ক্ষমা করে দিন! এরাই কিন্তু সেই সমালোচকদের দোসর। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে তো কত মানুষ যে সন্দেহ পোষণ করেছেন, কত দল যে গালমন্দ করেছেন, কত পত্রিকা, কত নেতা যে কত বিরূপ কথা বলেছেন; সেসবের শেষ নেই। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে কেন বিচার করেন নাই ইত্যাদি। অথচ তখন শেখ হাসিনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো, শ্রমিকের কল্যাণে কাজ করা, সাধারণ মানুষের অন্ন বস্ত্র চিকিৎসা শিক্ষা ও বাসস্থান নিশ্চিত করা। সেজন্যই প্রথমবার ক্ষমতায় এসে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাকের পরামর্শকে উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘আমার কৃষক’ ‘আমার মানুষ’ এর সুখের সন্ধান করেছেন কন্যা শেখ হাসিনা। আর বিচার যখন শুরু হলো তখন সকল সমালোচকের আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, যা শেখ হাসিনা পারেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ, দ্বিতীয় বিপ্লব অর্থাৎ অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যখন কাজ করে চলেছেন তখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও কুৎসার শিকার হতে শুরু হয়েছেন এবং হবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। তার কাজের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই সকল প্রশ্নের উত্তর। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ইয়র্ক হলে একটি সভায় নেত্রী বলেছিলেন- আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি চাই না। আমরা চাই জাতিকে কলংকমুক্ত করতে। শেখ হাসিনা ঠিকই জাতিকে কলংকমুক্ত করেছেন। এটাই হলো শেখ হাসিনার সেন্স অব টাইমিং। কখন কোনটা করতে হবে সেটা তিনি জানেন।
শুধু অপপ্রচার ও গুজবই নয়, বুলেট-গুলিও শেখ হাসিনার পায়ে পায়ে। এই প্রসঙ্গে ১৯৮১ সালের ১১ মে প্রকাশিত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজউইক-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ‘আমি নিহত হওয়ার আশংকার শঙ্কিত নই। এমনকি আমি সামরিক সরকারের শক্তিকে বাধা বলে গণ্য করি না। জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়’। এখানেই দেখা যায় সর্বহারা শেখ হাসিনার হারানোর কিছু নেই, জয় করার আছে সারাবিশ্ব। তিনি তাই করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা জাতীয় রাজনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দৃঢ় দীপ্ত পায়ে এগিয়ে আজ যে পর্যায়ে এসে বিশ্বের আলোকিত-দূরদর্শী-প্রজ্ঞাবান-সফল নেতৃত্বদানকারীদের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করেছেন, এসবই তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অনন্য নজির।
অনেকেই শেখ হাসিনাকে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও বৃটেনের মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করেন। তুলনা হতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্গারেট থ্যাচার কিংবা ইন্দিরা গান্ধী, কাউকেই শেখ হাসিনার মতো সংকট মোকাবেলা করতে হয় নি। একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তারা রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে বরং শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা যে সাহসের পরিচয় দিয়ে চলেছেন তা অনেক লৌহমানবীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। ইন্দিরা গান্ধী পিতা জওহরলাল নেহেরুর পরম্পরায় দেশ ও দলের নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন। শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে আসীন হলেও কিন্তু দলকে ক্ষমতায় এনেছেন এবং জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছেন অনেকটা স্বনির্মিত পথে। ইন্দিরা গান্ধী পিতার হাতেই রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছেন, পিতার বর্তমানেই দলের নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন। শেখ হাসিনার সেই সৌভাগ্য হয়নি। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীকে গণতন্ত্রের জন্য অসম শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি, পিতার হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় নি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্যও লড়তে হয় নি; কিন্তু শেখ হাসিনাকে এ-সবই করতে হয়েছে। একটা চরম প্রতিকূল সময়ে দলের হাল ধরেছেন, দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। পিতার সূত্রে এটুকুর পাশাপাশি শেখ হাসিনা পেয়েছেন পিতার দর্শন এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা। এসব নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে শুরু করতে হয়েছিল একেবারে বিরূপ পরিস্থিতি থেকে। বাইরের অপশক্তি তো বটেই, দলের ভিতরের নানান সংকটও মোকাবেলা করতে হয়েছে। একদিকে স্বৈরাচার, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং জঙ্গি মৌলবাদ; এসব মোকাবেলা করেই তিনি হয়ে উঠেছেন দল ও দেশের অদ্বিতীয় নেতা। বাংলাদেশ যে এখনও পর্যন্ত জঙ্গিগোষ্ঠীর দখলে যায়নি, এর প্রধান কারণও শেখ হাসিনা। জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, শেখ হাসিনাও যে রাজনীতিকে মর্মে ধারণ করে পথ চলছেন, এটাই দেশকে জঙ্গিমুক্ত রাখছে। ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাবেক সম্পাদক মানস ঘোষ এক লেখায় যথাযথই বলেছিলেন ‘শেখ হাসিনা উপমহাদেশের রাজনীতির এক অতুলনীয় বিস্ময়’।
একটি রাষ্ট্রকে উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যেতে হলে প্রথমে দরকার সুস্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং লক্ষ্যকে ঘিরে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। আর এই লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে লাগে নেতৃত্ব। গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক নেতৃত্ব তথা, স্ট্র্যাটেজিক লিডার থাকলেই কেবল সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব। আমাদের দেশে সেই স্ট্র্যাটেজিক লিডার তথা নেতৃত্ব হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এটা এমনি এমনি সম্ভব নয়, এজন্য স্বপ্ন দেখা লাগে, হতে হয় স্বপ্নবাজ। এখানে শেখ হাসিনার মধ্যে আমরা অপূর্ব সমন্বয় দেখতে পাই। স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, লক্ষ্য স্থির করছেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন এবং দক্ষ হাতে সকল কিছু বাস্তবায়ন করছেন। দক্ষ রাষ্ট্রনায়কের এ-এক অনুপম সৌন্দর্য! যে সৌন্দর্য কেবল আমাদেরই আছে, বাংলাদেশেরই আছে!
প্রতিটি মানুষের জীবনের দুটি দিক থাকে- প্রাইভেট(ব্যক্তিগত) এবং পাবলিক(সামষ্টিক)। প্রাইভেট লাইফে মানুষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, কর্মক্ষেত্রে উচ্চশিখরে পৌঁছে, দলের বড় নেতা হয়, এমপি-মন্ত্রী ইত্যাদি হয়। এসবই মানুষের ব্যক্তিগত অর্জন ও সাফল্য। ব্যক্তির এই সকল সাফল্য, সমাজ ও দেশের জন্য কতটুকু কল্যাণকর হবে সেটার উপরেই নির্ভর করে মানুষের পাবলিক লাইফের সফলতা। প্রাইভেট লাইফের যেসব অঙ্গীকার নিয়ে মানুষ উচ্চ আসনে আসীন হয়, সেসব অঙ্গীকার যদি কেউ পালন করেন তাহলে তাকে পাবলিক লাইফেও সফল বলা যায়। অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয় না, কিছু মানুষ ব্যতিক্রম। সকলের পক্ষেই এটা সম্ভব হলে একটি দেশ ও জাতির বেশিদিন লাগে না উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছাতে। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম উদাহরণ। তিনি প্রাইভেট ও পাবলিক লাইফ, উভয় ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। শুরু থেকে বর্তমান অব্দি কথা ও কাজের, অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের এমন নজির বিরল। বাংলাদেশের ‘ভিশনারি উন্নয়ন ও জনজীবনের স্বস্তি’ বড় উদাহরণ।
জাতির পিতা আমাদের ট্র্যাজিক হিরো, তার কন্যা সেই ট্র্যাজিক পথে হেঁটে নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়েছেন। এরকম ভাগ্যবিড়ম্বিত নেতা বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার এক লেখা উল্লেখ করেছেন- ‘কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যখন মা অথবা দিদি বোন ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না তখন সেই দেশ নিজের দেশ হয়ে যায়’। শেখ হাসিনার এই গুণের বদৌলতেই বাংলাদেশ সারাবিশ্বের কাছে নিজের দেশ হতে পেরেছে। শেখ হাসিনা নিজেও সকলের আপনজন হতে পেরেছেন। আজ সেই আপনজন শেখ হাসিনা’র জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, আমাদের আপনজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)