সারাক্ষণ তিনি কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু যখনই তাকে ডাকা হতো তিনি ‘না’ করতেন না। যত ব্যস্ততাই থাকুক তিনি চ্যানেল আইতে আসতেন। চ্যানেল আই পরিবারের তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সম্মানিত সদস্য। এমনও দিন গেছে তিনি সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে পরে যুক্ত হয়ে অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে হয়তো মধ্যাহ্নভোজ সেরে ছুটে গেছেন আরেকটি সভা- সেমিনারে।
যে কোনো কাজ তিনি করতেন গভীর নিষ্ঠা ও মননশীলতা দিয়ে। সমগ্র জীবন তিনি ব্যয় করেছেন বাংলা একাডেমিতে। আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে তার অবদান ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলা সন ও পহেলা বৈশাখ নিয়ে তার রচিত গ্রন্থই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। পহেলা বৈশাখ পালনের উৎসবে তার সক্রিয় ভূমিকা সবার জানা আছে। আমাদের গৌরবময় লোক সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তিনি তুলে ধরেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক উপাদান তিনি অতি যত্ন করে সংগ্রহ করেছেন।
আমাদের অমর একুশের বইমেলার সম্প্রসারণ, বাংলা একাডেমিতে বৈশাখি মেলা, শিশুকিশোর সংগঠন কচি কাঁচার মেলার কার্যক্রম সকলকিছু তিনি আন্তরিকভাবে করে গেছেন।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের কাজে শামসুজ্জামান খানকে সম্পৃক্ত রাখতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ হওয়া সত্বেও শামসুজ্জামান খানের ভেতর কোনো অহংবোধ ছিল না। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও তিনি কখনো কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। একেবারেই নিপাট ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। বঙ্গবন্ধুর লেখা বই তিনটি পাঠ-উদ্ধার, পা-ুলিপি প্রস্তুত, পরিমার্জনা করেছেন শামসুজ্জামান খান। গভীর প্রত্যয় ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুর রচনা নিয়ে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বই তিনটির প্রকাশনা কাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন। শেখ হাসিনা বইমেলার ভূমিকায় আন্তরিকভাবে গবেষক শামসুজ্জামান খানের কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু রচিত বইগুলো এখন ইতিহাস। জাতীয় সেরা সম্পদ সেই বই তিনটি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন। এই বই তিনটি আলোর মুখ দেখার ব্যাপারে শামসুজ্জামান খানের ভূমিকা আছে। সেই কারণেই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
শামসুজ্জামান খান ছিলেন অসম্ভব বই প্রেমিক ব্যক্তিত্ব। বই তিনি প্রচ- ভালোবাসতেন। দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করতেন। নিজের রচিত গ্রন্থের সংখ্যাও বিপুল। মূলত মননশীল প্রাবন্ধিক। এর বাইরে ছোটদের জন্যও তিনি অনেক লিখেছেন। বিচিত্র সব বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল। বাংলা একাডেমিতে তিনি প্রকাশনা শিল্পে অনেক ধরনের কাজ করেছেন। নানা বিষয়ের অভিধান, জেলাওয়ারি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদান, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ক বইয়ের জন্য তিনি প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বই নিয়ে তিনি চ্যানেল আইতে গত দশ বছর ধরে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করেছেন। ‘পাঠক সমাবেশ’ শিরোনামে পাঁচ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান তিনি নিয়মিত উপস্থাপনা করতেন। তিনি প্রায়ই একটি গল্প বলতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্বে, ঢাকা বা ঢাকার আশেপাশে কোথাও বইমেলা হচ্ছে। সেই মেলা প্রাঙ্গণে একটা গরু বাঁধা আছে। গরুর গায়ে লেখা আছে আমি বই পড়ি না।
এমন কৌতুকময় ঘটনা অনর্গল বলে যেতেন শামসুজ্জামান খান। গত অক্টোবরে চ্যানেল আই নিয়ে একটা বিশেষ স্মৃতিমূলক লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখার শেষ পংক্তি ছিল ‘চ্যানেল আইতে যাব আর সাগরের রুমে কফি খাব না এমন হতে পারে না।’
জামান ভাই, আপনি আর কখনো আসবেন না। আপনাকে আর কালো কফি খাওয়ানো হবে না।