ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের নামে আতশবাজি ফুটিয়ে আনন্দ প্রকাশ ও ফানুস উড়ানোর বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টরা। আতশবাজির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও সরব অনেকে। তারা বলছেন, আতশবাজি হাজারো প্রাণের মৃত্যুর কারণ। পরিবেশ, মানব এবং পশু-পাখিদের জন্য ক্ষতিকর ও জীবনের ঝুঁকি আছে এমন বিনোদন কারো জন্য কখনোই মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না।
আতশবাজি ও ফানুস উড়ানো বন্ধে বরাবরের মতোই এবারও কঠোর ভূমিকা রেখেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিতে ঢাকার ৫০ থানার ওসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ হতে ইতোমধ্যে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউবে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লিফলেট ও ভিডিও ক্লিপস শেয়ার করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিশেষ করে ঢাকার ফায়ার স্টেশনগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে; যাতে করে এ সংক্রান্ত যেকোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত রেসপন্স করা যায়।
থার্টিফার্স্ট নাইট ও নিউ ইয়ারে মেট্রোরেলের রুট অ্যালাইনমেন্টের আশপাশের এক কিলোমিটারের মধ্যে ফানুস বা অনুরূপ বস্তু না ওড়াতে ঢাকাবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
পাখিসহ নানা প্রাণী, শিশু ও বৃদ্ধদের কথা চিন্তা করে আসন্ন থার্টি ফার্স্ট নাইট-এ আতশবাজি ফুটানো ও ফানুস উড়ানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
ফেসবুকে সরব নেটিজেনরা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নাফিস সাদিক নামে একজন ব্যবহারকারী ‘থার্টি ফার্স্টে আতশবাজি ও ফানুসকে না বলি’ নামে ইভেন্ট ক্রিয়েট করেছেন। সেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে সাড়া দিয়েছে প্রায় লাখো ব্যবহারকারী।
৩১ ডিসেম্বর (রোববার) সকালে সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা একটি ছবি শেয়ার করেছেন যেখানে লেখা: আতশবাজি বর্জন করুন। বিকট শব্দে আনন্দ প্রকাশ করা বর্বরতা। আতশবাজি হাজারো প্রাণের মৃত্যুর কারণ।
সঙ্গীত শিল্পী, সুরকার গীতিকার ও কবি প্রবর রিপন এক পোস্টে বলেছেন মানুষের উৎসবের আতশবাজি, পটকার শব্দে আজ রাতে যে পাখিরা মরে যাবে; তাদেরকে শেষবারের মতো জানাই ‘বিদায়’।
রয়ালের ছবি কমিউনিকেশনের প্রতিষ্ঠাতা মমিনুল রহমান রয়াল পোস্টে বলেছেন সকলের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আজকের রাতে আমার বন্ধুতালিকায় কেউ যদি ফানুস কিংবা আকাশে যে কোন ধরণের আতশবাজির ছবি আপলোড করেন, আমি তাকে নিজ দায়িত্বে, সম্মানের সাথে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দেবো।
৩০ ডিসেম্বর (শনিবার) বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী জয়া আহসান এক ভিডিও বার্তায় ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেন ‘‘নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর মুহূর্তটি অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু আমাদের এই আনন্দ যে অন্যের মৃত্যুর কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আমরা যে আতশবাজি বা পটকা ফাটাই, এটা দয়া করে করবেন না। গত বছর এই আতশবাজির শব্দে কিন্তু শিশু উমায়ের কাঁপতে কাঁপতে মারা যায়। রাতের বেলা গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা আতশবাজির বিকট শব্দে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। রাস্তায় ঘুমানো যে পথ কুকুর বা বিড়াল; এমনকি আশপাশে যে অসংখ্য বন্যপ্রাণী প্রচণ্ড ভয়ে তারা ছুটোছুটি করে, অনেকেই মারা যায়। অনেকের বাসায় অসুস্থ মানুষ থাকেন, তারা কষ্ট পান। মনে রাখবেন, পৃথিবী-সমাজ কোনোটাই কিন্তু শুধু মানুষের একার নয়। যারা থার্টিফার্স্ট উদযাপন করতে আতশবাজি বা ফানুশ ওড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্লিজ দয়া করে এই কাজটি করবেন না। দয়া করে পরিমিত থাকুন। আপনার নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে কারও জীবন যেন বিপন্ন না হয়।’’
বার্ডস বাংলাদেশ নামক একটি গ্রুপ পোস্ট করেছে ‘‘আসছে ৩১ ডিসেম্বর, বরাবরই এই দিন সূর্যাস্তের পর সারা বিশ্ব মেতে ওঠে নতুন বর্ষকে বরন করে নেবার প্রস্তুতিতে। আতশবাজি, পটকা, ফানুস শুধু ৩১ ডিসেম্বরই নয়, এই আতশবাজি, পটকা, ফানুস সারা বছরই আমাদের বিনোদনের খোরাক হিসেবে প্রথম সারির নাম। আমরা কি জানি এই আতশবাজি, পটকার মধ্যে কি আছে? আতশবাজিতে ৭৫% পটাশিয়াম নাইট্রেট, ১৫% চারকোল এবং ১০% পর্যন্ত সালফার থাকতে পারে। এগুলোর প্রত্যেকটিই পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। আর এর শব্দে আতঙ্কে থাকে রোগী, শিশু এবং পশু-পাখিরা। পরিবেশ, মানব এবং পশু-পাখিদের জন্য ক্ষতিকর ও জীবনের ঝুঁকি আছে এমন বিনোদন আপনার-আমার জন্য কখনোই মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না। আসুন নতুন দিনকে বরণ করি মঙ্গলের আনন্দে, আতশবাজি, পটকার শব্দে ও ফানুসের আগুনে জীবনের ঝুঁকি বাড়ে হয় এমন কিছু দিয়ে নয়।’’
আতশবাজিতে প্রাণীরা চমকে ওঠে
আতশবাজির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে এবং এটি বন্ধে রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রাণীপ্রেমী সংগঠন পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ারের (প ফাউন্ডেশন) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল।
স্থপতি রাকিবুল বলেন: আতশবাজি বা পটকাবাজি মূলত তিন ধরণের ক্ষতি করে। এগুলো ফুটানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়, যা আমাদের চারিদিকে শব্দ দূষণ ঘটায়। এই শব্দ শিশু, বৃদ্ধসহ অসুস্থ রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আতশবাজির শব্দে প্রাণীরা চমকে উঠে। এছাড়া এতে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। এর কারণে প্রতিবছর হাজারো পাখি ও বন্যপ্রাণী অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পথে থাকা কুকুর-বিড়াল ভয়ে ছোটাছুটি করে, আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
গতবছর আতশবাজি ফানুস উড়ানোতে ক্ষতি ২০ লাখ টাকা
ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০২২ সালের থার্টি ফাস্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানোর কারণে প্রায় ১০০টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে; যাতে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়।
আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানো থেকে ২০২১ সালে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয় এবং আতশবাজির উচ্চশব্দে তানজিম উমায়ের ওরফে মাহমুদুল হাসান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৭২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং ২০১৮ সালে ৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৫৬ লাখ ৬ হাজার টাকার ক্ষতি সাধন হয়। সবমিলিয়ে পাঁচ বছরে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এসব অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকার সম্পদ উদ্ধার করে।
কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পুলিশ
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষ্যে রাজধানীর যেসব এলাকায় ফানুস ও আতশবাজি বিক্রি হয় সেসব জায়গায় গত কয়েক দিন ধরে অভিযান পরিচালনা করেছে ডিএমপির বিভিন্ন থানা পুলিশ। স্থানীয় ফানুস বিক্রেতাদের ফানুস বিক্রি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া ডিএমপির প্রতিটি থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট থানাধীন এলাকায় যেন কোনোভাবে থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে ফানুস বিক্রি ও উড়ানো না হয়। তারপরেও যদি কেউ ফানুস ওড়ায় তাহলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পুলিশ।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নগরবাসীকেও কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তারা যেন এগুলো মেনে চলেন। আতশবাজি পটকা ফুটানো এবং ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ। এ বিষয়ে প্রতিটি থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে করে আতশবাজি পটকা ফুটানো এবং ফানুস ওড়ানো না হয়। এছাড়া ফানুস ও আতশবাজি যেসব এলাকায় বিক্রি হয় সেসব জায়গায় আমিরা অভিযান পরিচালনা করেছি।