
এক সপ্তাহ হলো জ্বর, তিন দিন আগে ডাক্তারের পরামর্শে এনএসওয়ান ডেঙ্গু টেস্ট করার পর পজেটিভ আসে সাভারের গার্মেন্টস কর্মী আকলিমা খাতুনের। শুরুতে বাড়িতে অবস্থান করলেও অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছিলেন স্বজনেরা। কিন্তু সমস্যা তাতে কমেনি বরং বেড়েছে। কারণ ডেঙ্গু চিকিৎসায় অপরিহার্য ‘স্যালাইন’ মিলছেনা কোথাও। দোকানিদের হাতে পায়ে ধরলেও মিলছে না স্যালাইন।
তাই স্যালাইনের খোঁজে এক পরিচিতজনকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই নেমে পড়েছেন স্যালাইনের খোঁজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বারডেম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন আজিজ সুপার মার্কেটের ওষুধের দোকান ঘুরে পাননি এক ব্যাগ স্যালাইনও। পরে মোহাম্মদপুরের একটি ফার্মেসিতে কাঙ্খিত স্যালাইন পান আকলিমা। সেখানে থাকা ওষুধের দোকানদারের সহায়তায় স্যালাইন পুশ করে আবারও হাসপাতালের পথ ধরেন তিনি। এই চিত্র ধরা পড়েছে চ্যানেল আই অনলাইনের ক্যামেরায়।
শুধু আকলিমা নন, এ চিত্র পুরো ঢাকা শহরের। কোথাও মিলছেনে শিরায় দেওয়ার স্যালাইন। স্যালাইনের সংকটে ডেঙ্গু ছাড়াও যেসকল চিকিৎসা স্যালাইনের ওপর নির্ভরশীল সেগুলো থমকে পড়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ: সংকট দেখিয়ে আগে বাড়তি দামে দোকানিরা স্যালাইন বিক্রি করলেও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর থেকে ক্রেতাদের কাছে স্যালাইন বিক্রি করছেন না বিক্রেতারা। রাজধানীর মিডফোর্ড, ঢাকা মেডিকেল, শাহবাগ, কলেজ গেট, মিরপুর এলাকা ঘুঁরে এ চিত্র দেখা গেছে।
বিক্রেতারা বলছেন: কোম্পানি গুলো তাদের চাহিদা মতো স্যালাইন সরবরাহ করছেনা। দিন ১৫ আগে ১০০০ এমএলের স্যালাইনের সংকট ছিলো। এখন কিছু কিছু ১০০০ এমএলের স্যালাইন পাওয়া গেলেও ৫০০ ও ২৫০ এমএলের স্যালাইনের সাপ্লাই নাই। তাই এ সংকট তৈরি হয়েছে।

কিন্তু তথ্য বলছে: বিক্রেতাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ স্যালাইনের স্টক থাকলেও তারা তা বিক্রি করছেন না। যদি তার কাছ থেকে বেশি পরিমাণ ওষুধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তাহলে দু’একটা স্যালাইন দিচ্ছে। দাম বাড়িয়ে বিক্রি এবং ভোক্তা অধিকারের অভিযানের কারণে তারা স্যালাইন বিক্রি করছেন না।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় স্যালাইন কেনো লাগে? চিকিৎসকরা বলছেন: ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তার রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে দিতে হয় ডিএনএস স্যালাইন। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় সাধারণত শরীরে পুশ করতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বেশিও স্যালাইন দেয়া লাগতে পারে।
ডেঙ্গুর পাশাপাশি ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমো তৈরিতে স্যালাইন অপরিহার্য। স্যালাইনের অনেক রোগি সাইকেল অনুসারিকেমো থেরাপি নিতে পারছেন না।
বিজ্ঞাপন
চ্যানেল আই অনলাইনের এই প্রতিবেদক ঢাকা মেডিকেল, শাহবাগ, মগবাজার, গ্রীন রোড এলাকার ৬৭টি ফার্মেসি ঘুঁরে পরিচয় প্রকাশ না করে ১০০০, ৫০০ ও ২৫০ এমএলের স্যালাইন কেনার চেষ্টা করেন। তার মধ্যে মাত্র ২টি দোকানে ১০০০ এমএলের স্যালাইন আছে জানালেও কারও কাছে ৫০০ ও ২৫০ এমএলের স্যালাইন নেই বলে জানান বিক্রেতারা।
আজিজ সুপার মার্কেটে ওষুধ কিনতে আসা কবির হোসেন নামে এক রোগীর স্বজন বলেন: আমার ছোট ভাই ডেঙ্গু আক্রান্ত। অনেক কষ্টে গতকাল বাড়তি দামে স্যালাইন কিনেছিলাম। এখন আবার ভাইয়ের শরীরে স্যালাইন পুশ করতে হবে। গতকাল যে দোকান থেকে স্যালাইন নিয়েছিলাম সেই দোকানে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করলাম, বললো স্যালাইন নেই। তাই আজ কলাবাগান, সিটি কলেজ, নিউমার্কেট, গ্রীন রোড ঘুঁরে এখন শাহবাগে আসছি। অনেকেই বলেছিল শাহবাগে পেতে পারেন। কিন্তু এখানে এসে দেখি কোনো দোকানে স্যালাইন নেই। এখন কী যে করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
এভাবেই রোগীদের জন্য স্যালাইন কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন স্বজনরা। এমনই একজন গাইবান্ধার বাসিন্দা আলী হোসেন। ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় ঢাকার একটি স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। হাসপাতাল থেকে একটির ব্যবস্থা করা হলেও এখন তার ছেলের প্রয়োজন আরও ১ লিটার স্যালাইন। তাই ধানমণ্ডি, ফার্মগেট, মগবাজার ঘুঁরে শাহবাগে এসেছেন স্যালাইন কিনতে। কিন্তু শাহবাগেও পাননি কাঙ্ক্ষিত স্যালাইন। দোকানিদের হাতে-পায়ে ধরে বেশি টাকা দিলেও জোটেনি ১টি প্যাকেট স্যালাইন।
চোখ মুছতে মুছতে আলী হোসেন বলেন; ছেলেটা অনেক অসুস্থ। একদম বিছানা ধরা ধরা। উঠে বসতে পারছে না। প্লাটিলেটও অনেক কম। ডাক্তার বলেছে স্যালাইন লাগবে। অনেক জায়গায় খোঁজ করলাম। কোথাও একটি স্যালাইন পেলাম না। বলে সাপ্লাই নাই। আমি এখন কি করবো?
স্যালাইনের সরবরাহ সংকট প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন: ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছেন, ১০০ টাকার স্যালাইন ৪০০ টাকা রাখছে, স্টকে থাকলেও বলছে নাই। জাতীয় দুর্যোগে যারা এসব কাজ করে তারা তো দেশপ্রেমিক না।
বিজ্ঞাপন