মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর চলমান রোহিঙ্গা নির্যাতনের চিত্র ২৮ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং বাংলাদেশ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। জাতিসংঘ এই নির্যাতনকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে। মিয়ানমার আগের মতই সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মহাসচিবের বক্তব্যের সূত্র ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দায়ী করে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাসহ সে দেশের সামরিক বাহিনীর উপর কার্যকর পদক্ষেপ নেবার জন্য জোরালো বক্তব্য রেখেছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করে চীন বলেছে, এ সমস্যার আশু সমাধান নেই। রাশিয়া রোহিঙ্গা নির্যাতনের দায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’র (আরসা) উপর চাপিয়ে বলেছে, মিয়ানমারের উপর বেশী বেশী চাপ দিয়ে লাভ হবে না; শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ সংশ্লিষ্ট দেশ এবং সম্প্রদায় সমূহের মধ্যে সংলাপ লাগবে। চীন এবং রাশিয়ার আপত্তির কারণে বৈঠকের ফলাফল শূন্য। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোন সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা পরিষদ গ্রহণ করতে পারেনি।
আমেরিকা যেখানে পারে সেখানে চীনের উপর এক হাত নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে অনেক দিন থেকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের উপর আরও একহাত নেয়ার সুযোগ আছে আমেরিকার। জাতিসংঘের সাধারণ এবং নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সে কাজটাই করে দেখাল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও মিয়ানমারের রাজনীতি এবং সম্পদের উপর কর্তৃত্ব নেবার পথ বাতলাতে পারেনি। বার্মিজ রাজনীতি এবং সম্পদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে চীনের। ছিটেফোঁটা কিছু ছাড় পায় ভারত, জাপান এবং পশ্চিমারা। চীনের বন্ধু বলে কিছু ভাগ আছে পাকিস্তান এবং রাশিয়ার। দীর্ঘ চেষ্টায় মিয়ানমারের সম্পদের উপর কর্তৃত্ব আরোপের সুযোগ না পেয়ে পশ্চিমারা এবার উচ্ছিষ্টের মায়া ছেড়ে মিয়ানমারে চীনকে ধরাশায়ী করার অভিপ্রায়ে কোমর বেঁধে নেমেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে জাপান ও ভারত। চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধ রাজনীতির কারণে হোক কিংবা বিপন্ন মানবতার পক্ষে থাকার কারণেই হোক; পশ্চিমাদের ভূমিকা এবার রোহিঙ্গাদের পক্ষে। তাদের এই ভূমিকা বাংলাদেশের অবস্থানকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কাজাখস্তানে এবং প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে ওআইসি নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেও তাদের দিবানিদ্রা ভঙ্গ হচ্ছে না। সংকটের শুরুতে ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্কের সরব উপস্থিতি দেখা গেলেও বর্তমানে তাদের ভূমিকা চোখে পড়ছে না। আমেরিকার অনুসারী আরব বিশ্ব যদি জোরালো ভূমিকা রাখে; যদি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের সামান্য ইঙ্গিতও দেয় তবে চীন ফাঁপর খাবে। আরব বিশ্ব, ভারত এবং পশ্চিমারা সকলেই চীনের বিরুদ্ধ রাজনীতি করে। এরা সকলে মিলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জোরালো ভূমিকা রাখলে চীনের অবস্থান দুর্বল হতে বাধ্য।
চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকে সত্য-মিথ্যা, ফটোশপ প্রচারণা করে জামায়াতী জঙ্গিরা দেশে একটা যুদ্ধের উম্মাদনা তৈরীর চেষ্টা করেছে। জঙ্গিবাদী, মৌলবাদী আর পেট্রোল বোমাবাজেরা তাতে বেশ সাড়াও দিয়েছে। সে সাড়ায় নাড়া দিতে বিএনপি লং মার্চ করার ঘোষণা দিয়েছিল। লং মার্চের কথা বলে তারা আসলে একটা যুদ্ধ উম্মাদনা তৈরীর চেষ্টা করেছে। যুদ্ধ উম্মাদনায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক করে বিষয়টাকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার একটা চেষ্টা তাদের ছিল। কিছু সংখ্যক উগ্র ইসলামী সন্ত্রাসবাদী ছাড়া সুস্থ চিন্তার শান্তিকামী সাধারণ মানুষ জামায়াত-বিএনপি’র উস্কানিতে আন্দোলিত হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপি’র অহেতুক সমালোচনা সাধারণ মানুষ কানে তুলছে না। অস্থিরতা, নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করে অতীতের মত আবারও তারা গণধিকৃত হয়েছে।
উগ্র ইসলামপন্থিদের অহেতুক জঙ্গি আবেগের তোয়াক্কা না করে সরকার এগিয়েছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে। সরকারের এই কৌশল কাজ দিয়েছে। সমগ্র পৃথিবী এখন বাংলাদেশের মানবতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাভার্ড ডিভাইনিটি স্কুলের ডিন ডেভিড এন হেম্পটন মনে করেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শান্তির নতুন মাত্রা দিয়েছে। কেবল শান্তির স্বার্থে দেশটি চরম অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছে।” তার মতে, “এতগুলো শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য মানবিক হৃদয় লাগে। জার্মানি যা করতে পারেনি, শেখ হাসিনা তা করে দেখিয়েছেন।” বিশ্ব নেতারা এখন কথা বলছেন শেখ হাসিনার সুরে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাচ্ছেন শেখ হাসিনার দেখানো পথে। জাতিসংঘে দেয়া শেখ হাসিনার ৫ দফা আজ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্র। মূলের মূলে কাজ করেছেন কফি আনান।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন বিরোধ নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পার্শ্ববর্তী দেশ বলে বাংলাদেশ তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার দায় বইছে মাত্র। বাংলাদেশ একদিকে তার সীমিত সামর্থ নিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য দেয়া চালিয়ে যাবে। অন্যদিকে বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে যাবে; রোহিঙ্গাদের দায় বিশ্বের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের সঙ্গে শেয়ার করার চেষ্টা করবে। মিয়ানমারের সঙ্গে অহেতুক যুদ্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ দফা প্রস্তাব রোহিঙ্গা জীবনে ম্যাগনাকার্টা হয়ে থাকবে। প্রস্তাবগুলো হচ্ছেঃ ১) অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা; ২) অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল (Fact Finding Mission) প্রেরণ করা; ৩) জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (safe zones) গড়ে তোলা; ৪) রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; ৫) কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
শেখ হাসিনার ৫ দফা বাস্তবায়নে প্রধান বাধা চীন আর রাশিয়া। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বাধা না দিলে ৫ দফা পাস হয়ে দ্রুত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের মর্যাদা সহকারে ফেরত পাঠানো যেত। এখনই বাস্তবায়ন শুরু করা যেত কফি আনান কমিশনের পরামর্শগুলোকে। চীন ও রাশিয়া তা করতে দিচ্ছে না। এ পথে আগানো যাচ্ছে না। জাতিসংঘে মিয়ানমারের অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে তারা সমাধানের পথ খুলছে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে।
চীন ও রাশিয়ার দেখানো পথেই হাঁটছে মিয়ানমার। তারা বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করবে। সে মোতাবেক ১৯৯৩ সালের চুক্তি অনুসারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ সফরে আসছে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসলেই তারা গুড বয়ের মত তাদের সকল নাগরিকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরত নিয়ে যাবে – বিষয়টা এত সহজ হবে না। চীন চাপ না দিলে মিয়ানমার সহসা এ সমস্যার সমাধান করবে না।
চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি যখন পশ্চিমাদের সমর্থনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বাংলাদেশর রাজনীতি অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, এই দুই দেশ তখন ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক এখনো যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এখন রাশিয়া, চীন, ভারত এবং জাপান সফর করে তাদের সরকার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা উচিত।
সু চিকে যারা গালাগালি করছেন তারা তার বাস্তবতাকে বুঝতে পারছেন না বা বুঝেও অস্বীকার করছেন। প্রায় ৬০ বছর ধরে চলা রোহিঙ্গা বিদ্বেষ মাত্র ১৮ মাসে শেষ করে দেবেন এমন আসমানি শক্তি তার নেই। ধীর গতিতেই হবে সমাধান। সে জন্যই রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে গঠন করেছেন কফি আনান কমিশন। সে দেশের সেনাবাহিনীকে না খেপিয়ে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য পথ খুলেছেন সু চি। সু চি’র সঙ্গে কোন শত্রুতা না করে বরং মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রেখে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কৌশল নিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। পশ্চিমারা যতই বড় বড় কথা বলুক না কেন, তাদের কথায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। সু চি, চীন, রাশিয়া, জাপান এবং ভারতকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান।
চীনের ছত্রচ্ছায়ায় বহুকাল রোহিঙ্গা নিধন করে উগ্র বৌদ্ধদের সমর্থন ধরে রেখে বার্মা শাসন করেছে সেনাবাহিনী। বিশ্বমত এখন চরমভাবে তাদের প্রতিকূলে। স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধরা ছাড়া তাদের সঙ্গে যে আর কেউ নেই তার প্রমাণ দেখা গেছে ২০১৫ সালের নির্বাচনে। রাজনীতিতেও তারা দিন দিন গণতন্ত্রীদের কাছে পিছিয়ে পড়েছে। বন্দুকের নলে ক্ষমতা বেশী দিন ধরে রাখা যায় না। সংসদে তাদের যে ২৫% আসন আছে তা বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে তারা আসলে নিজেদের ক্ষমতার কফিনে আরও কয়েকটি পেরেক ঠুকেছে। অবশিষ্ট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তাদের এখন ব্যারাকে ফিরে যাবার সময় এসেছে। তাদের এখন সময় হয়েছে মধ্যযুগীয় জাতিগত সহিংসতা বাদ দিয়ে আধুনিক পৃথিবীর উন্নত মানুষ হওয়ার। চীন চাপ বাড়ালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জনসমর্থন লাভের বর্বর পদ্ধতি দ্রুত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। আর তা হবার জন্য সু চি ও তার দলকে পশ্চিমাদের প্রতি বাড়তি প্রীতি পরিত্যাগ করতে হবে।
চীন এবং রাশিয়া বিশ্ব ব্যবস্থার প্রধান কারিগর হতে চাইছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যযুগীয় বর্বরতা, গণহত্যার দায় নিয়ে বিশ্বনেতা হওয়া যায় না। স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। চীনকে দিয়ে এই কাজটি করাতে হবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের ভূমিকা হচ্ছে চীনের এই কাজকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। এটাই বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ। অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এই চ্যালেঞ্জটি জয় করতে পারলে বিশ্ব নেতৃত্বের কালজয়ী আসনে আসীন হবেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)