সাম্প্রতিকতম সময়ে বাংলা ভাষায়, বাংলাদেশ অঞ্চলে যে সমস্ত চলচিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজন ইমতিয়াজ পরিচালিত “মাটির প্রজার দেশে”, জান্নাতুল ফেরদৌস নীলা পরিচালিত, সরকারি অনুদানের ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আড়ং’ এবং আসিফ ইসলাম পরিচালিত ‘পাঠশালা’ নামক চলচ্চিত্র ব্যতিত অন্য সকল চলচ্চিত্রে শিশুতোষ ভাবনা চিন্তা অনেকটাই অনুপস্থিত।
কিন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ সকল চলচ্চিত্র শিশু নির্ভর বা শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্ভর হলেও কাহিনী বিন্যাস বা ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেই আক্রান্ত করছে। খুব সম্ভবত এই জায়গাটায় ‘আম কাঁঠালের ছুটি’ সমসাময়িক অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রগুলোকে ছাপিয়ে যায়।
এর অনবদ্য বক্তব্য, প্রকাশভঙ্গি, উপস্থাপনের ভাষা, দর্শককে বিমোহিত করে, উদ্বেলিত করে এবং নিজের অতীত হাতড়ে ফিরতে বাধ্য করে!
সাদাকালো ফ্রেমে ১৬/৯ –এর জানালায় নিজের অথবা নিজেদের অতীতকে দেখতে পাওয়া, অতীতের শব্দরাজিগুলোকে শুনতে পাওয়া, গন্ধগুলোকে শুকতে পাওয়ার এক অপার অনুভূতির নাম ‘আম কাঠালের ছুটি’।
তথাগত চলচ্চিত্র নির্মাণের সকল প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভেঙে, গুড়িয়ে, বাঁকিয়ে যেভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং তার দল চলচ্চিত্রটিকে দর্শকের সামনে হাজির করেন তা অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার।
প্রচলিত অর্থের তারকা কিংবা পরিচিত মুখের অনুপস্থিতি, গতানুগতিক উচ্চ সুরে বাঁধা অভিনয়ের গদবাঁধা রীতি, গানের ব্যবহার, নাচের ব্যবহার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইটেম সং-র মতো উদ্ভট বিষয়াবলীর উপস্থাপন বিবর্জিত এই চলচ্চিত্র বোধ করি আমাদের সকলের মনের আনাচে-কানাচে প্রবেশ করে আমাদের মনের মধ্যে শুয়ে থাকা, ঘুমিয়ে পড়া শিশুটিকে নাড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস।
গল্পের গাঁথুনি এবং তার পরতে পরতে বাজারী অর্থে অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং শিশু শিল্পীদের অভিনয় আমাকে করেছে মুগ্ধ, অভিভূত এবং একই সঙ্গে বাকরুদ্ধ করেছে। খুব সাদামাটা নির্মল গল্পের উপস্থাপনে সত্যজিৎ রায়ের “টু” সিনেমাটিকে হালকা করে ছুঁয়ে যাওয়া কিংবা “চাঁদ মামা আজ বড্ড একা বড় হয়েছি আমি” -গানটির লাইনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়া অথবা “শেষ কবে” কবিতার শেষ কবে প্রশ্নগুলোর উত্তর চলচ্চিত্রটিতে সেলুলয়েডে গাঁথা!
এন্ড টাইটেলে পরিচালক, প্রযোজক, সম্পাদক এবং শব্দ সম্পাদক হিসেবে নিজে কাজ করার যে কৃতিত্ব তা অভূতপূর্ব।
ওটিটি-র এই জামানায় যখন অশ্লীলতা তার চূড়ান্ত প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের নিউরনে অনুরণন ক্রমাগত তৈরি করে যাচ্ছে সে সময় এই ধরনের একটি পরিচ্ছন্ন নির্মল চলচ্চিত্র যা পরিবারের সকলকে নিয়ে একসঙ্গে বসে উপভোগ করা যায়, আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া যায় তা সত্যি বিরল।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয় কিছু টেক্সটের মাধ্যমে যে টেক্সটের মাধ্যমে পুরো টিম জানিয়ে দেয় তথাগত চলচ্চিত্র ভাষা এর টেকনিক এবং লারজার দ্যান লাইফ কোন প্রিপারেশন ছাড়াই শুধুমাত্র নির্মল গল্পের উপস্থাপনের টুলস হিসেবে সিনেমাকে ব্যবহার করে এই ধরনের একটি অসামান্য চলচ্চিত্র সৃষ্টি করা যায়।
এখানে মনে পড়ে যায়, জ্যাঁ ককতোর সেই কথাটি, তিনি বলেছিলেন, যেদিন সকলের হাতে হাতে ক্যামেরা পৌঁছে যাবে, সেদিন সিনেমা প্রকৃত সিনেমা হয়ে উঠবে। “আম কাঠালের ছুটি”র পর ককতো বেঁচে থাকলে কী বলতেন জানতে আজ বড় সাধ জাগে!
আম কাঁঠালের ছুটি
নির্মাতা: মোহাম্মদ নূরুজ্জামান
সিনেমার ব্যাপ্তী: ১০৪ মিনিট
অভিনয়শিল্পী: লিয়ন, জুবায়ের, আরিফ, হালিমা, তানজিল, ফাতেমা প্রমুখ
যেসব প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেখা যাচ্ছে: বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ব্লকবাস্টার, লায়নস (কেরানিগঞ্জ), সিলভার স্ক্রিন (চট্টগ্রাম), সিনেস্কোপ (নারায়ণগঞ্জ)।
লেখক: শৈবাল সারোয়ার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতা