চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

হাসান আরিফ: ক্ষণজন্মা আবৃত্তিজন ও সাংস্কৃতিক সংগঠককে স্মরণ

মানবিকতা-মাতৃভূমি-মুক্তিযুদ্ধ-মাতৃভাষা যাঁর শিল্পচেতনার উৎস সেই মানুষের নাম হাসান আরিফ। যিনি ভাই বন্ধু গুণী ও ত্যাগী তিনি হাসান আরিফ। অনেক বড় মাপের যে মানুষ একান্ত কাছের তিনি হাসান আরিফ। আবৃত্তিশিল্পী, সংগঠক,নির্দেশক, প্রশিক্ষক হাসান আরিফকে বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠক। হাসান আরিফ ছিলেন সার্বক্ষণিক সক্রিয় সংগঠক। মাত্র ৫৭ বছরের জীবনে প্রিয় দেশজুড়ে তাঁর কত যে কর্মের স্বাক্ষর! হাসান আরিফ।

১৯৬৫ সালের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লার সাহেব বাড়ি নানার বাড়িতে জন্ম। মা রওশন আরা। বাবা আবুল ফজল মো. মফিজুল হক। বড় ভাই হাসান ইকবাল আর ছোট বোন রাবেয়া রওশন। বসবাস ছিল ঢাকায়। পরিবারেই সাংস্কৃতিক পরিবেশের মাঝে বড় হয়েছেন হাসান আরিফ। আবৃত্তি শিল্পের শক্তিতে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন হাসান আরিফ। পারিবারিক পরিবেশেই সংস্কৃতি চর্চার শুরু। চর্চা ছিল গানেরও। ১৯৮৩ সালে দেশের প্রথম দিকের আবৃত্তি সংগঠন স্বরিত আবৃত্তি চক্রের সাথে যুক্ত হন তিনি। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সংগঠনভিত্তিক আবৃত্তি চর্চার শুরু। আটের দশকেই আবৃত্তিশিল্পে গুণী শিল্পী ও সংগঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান হাসান আরিফ। রাজধানী এবং ঢাকার বাইরের মঞ্চ ও গণমাধ্যমে তাঁর নিয়মিত পরিবেশনা মুগ্ধ করে মানুষকে। নিজের এবং অন্য সংগঠনগুলোর আয়োজনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি একক আবৃত্তি অনুষ্ঠানও করেন হাসান আরিফ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের বাইরে বিভিন্ন মঞ্চে তাঁর উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি পরিবেশনা রয়েছে। কিছু যৌথ ও একক অ্যালবামে তাঁর আবৃত্তি সারাদেশ এবং দেশের বাইরের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ডিজিটাল যোগাযোগের দ্রুত বিকাশের এই সময়ে ফেসবুক-ইউটিউবসহ অনলাইন মাধ্যমেও তাঁর অনেক আবৃত্তি রয়েছে।

বিভিন্ন সংগঠনের সাথে আবৃত্তি প্রযোজনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনা করেছেন হাসান আরিফ। এ পর্যায়ে তাঁর প্রথম প্রযোজনা রাতে আবৃত্তি সংসদের সাথে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি প্রযোজনাগুলো হলো রাতের সাথে ‘মুক্তিযুদ্ধ রূপকথা নয়’ ও ‘উত্তর নেই প্রশ্নের পাহাড়’; দৃষ্টি এবং চট্টগ্রামের প্রমার সাথে ‘মা’, প্রমার সাথে ‘জননী বাংলা’, শ্রুতিঘরের সাথে ‘মুক্তিযুদ্ধ নিরন্তর’,স্বরব্যঞ্জনের সাথে ‘ঘুম নেই অতঃপর’, স্বরশ্রুতির সাথে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘চিৎকার কর মেয়ে’, পাবনার বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের সাথে ‘রাখাল রাজার গল্প শোনো’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের সাথে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’। সব কাজেই মুক্তিযুদ্ধ দেশ আর মানুষের কথা বলে গেছেন এই গুণী। প্রযোজনাগুলোর মধ্যে, ‘উত্তর নেই প্রশ্নের পাহাড়’ করোনাকালে অনলাইনে নির্মাণ ও প্রচার করা হয়েছিল। হাসান আরিফের ইচ্ছে ছিল, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এর মঞ্চায়ন করবেন।

কিছু উপন্যাসের শ্রুতি পরিবেশনায় কণ্ঠ দিয়েছেন হাসান আরিফ। এর মাঝে ফৌজিয়া খানের নির্মাণে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। তাঁর এ ধরনের আরও কিছু কাজ অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। শিল্পবোদ্ধারা বলেন, হাসান আরিফের নির্মাণ ও পরিবেশনায় সুস্পষ্ট স্বকীয়তা ছিল; সুগভীর চিন্তার প্রতিফলন ছিল। এই শিল্পের বিকাশে কিছু সফল নিরীক্ষাও তিনি করে গেছেন। তাঁর পরিবেশনা এবং প্রযোজনাগুলোর মধ্যে এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। দেশজুড়ে যে আবৃত্তি প্রশিক্ষণগুলো তিনি পরিচলনা করেছেন সেখানেও আবৃত্তির আঙ্গিক নির্মাণে সৃজনশীল চিন্তার কথা ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন হাসান আরিফ।

সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চায় হাসান আরিফ এক পর্যায়ে আবৃত্তি সংগঠন শ্রুতিঘর এর সাথে যুক্ত হন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই সংগঠনের সাথেই ছিলেন তিনি। শ্রুতিঘরের জন্য অনেক দলীয় আবৃত্তি ও আবৃত্তি প্রযোজনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনা করে গেছেন হাসান আরিফ। আবৃত্তিশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য হাসান আরিফকে গোলাম মুস্তাফা আবৃত্তি পদক এবং বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি স্মারকে ভূষিত করে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এ ছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। হাসান আরিফ তাঁর স্বজনদের কাছে বলতেন, দেশের আবৃত্তিশিল্পকে তিনি যে উচ্চতায় দেখে যেতে চেয়েছিলেন তা পারলেন না।

সংস্কৃতির বিকাশে সাংগঠনিক চর্চার অনুসরণীয় গুণী হাসান আরিফের জীবনে শিল্পচর্চা ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড হাত ধরাধরি করে চলেছে। নিজে আবৃত্তি সংগঠন যেমন করেছেন অন্য সংগঠন গড়ে তুলতেও সহযোগিতা করেছেন তিনি। এই কাজ তিনি করেছেন দেশজুড়ে। হাসান আরিফ দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাথে শুরু থেকেই সক্রিয় হাসান আরিফ এক পর্যায়ে এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই দায়িত্ব পালন করেন।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আন্দোলনে ভূমিকার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদ প্রতিরোধেও সোচ্চার ছিলেন হাসান আরিফ। রাজধানীতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নির্মম জঙ্গি হামলার পর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে গুলশান পর্যন্ত গান-কবিতার মিছিল শিরোনামে যে সৃজনশীল কর্মসূচি হয়েছিল, তার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন হাসান আরিফ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)