বাংলা ভাগের যন্ত্রণা আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাকে। তাইতো থিয়েটার, সৃজনশীল লেখাযোখা আর সিনেমায় সেই যন্ত্রণার কথা বার বার তুলে ধরেছেন। যেনো এক ক্ষ্যাপাটে আত্মা! ঋত্বিক ঘটক। জনপ্রিয়তার লোভে বিক্রি হয়নি সেই নীলকণ্ঠ। বাংলা সিনেমার এই স্পর্ধার জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর!
ডাক নাম ভবা। তাঁর জন্ম ঢাকায়, কিংবা তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ময়মনসিংহ থেকে শুরু অথবা রাজশাহীর বয়ে যাওয়া পদ্মার সাথে তাঁর রয়েছে চিরন্তন এক প্রেমের সম্পর্ক! এইভেবে তিনি বাংলাদেশিদের যতোটা কাছের মানুষ, তারচেয়ে ঢের বেশি তিনি সকলের প্রিয় তার সৃষ্টিশীল কাজের জন্য। তিনি যদি সৃষ্টি না করতে পারতেন তাহলে ৪৭ এর দেশভাগের পর এপার বাঙলা ছেড়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের মতোন তিনিও ভুলে যাওয়া মানুষের কাতারেই থাকতেন!
কিন্তু ঋত্বিক ঘটককে কেউ ভুলে যাবে, এজন্য তিনি জন্ম নেননি। কেউ ভুলে যেতে চাইলেও ইতিহাস তাকে স্মরণ করাবে। মানুষ তাঁকে স্মরণ রেখেছে তার অসাধারণ প্রতিভার জন্য, স্রষ্টাসুলভ আচরণের জন্যে। এটা তাঁর প্রতি বাংলার স্বজনপ্রীতি নয়, স্বজনপ্রীতি চলে প্রতিভাহীনদের সাথে। ঋত্বিক ঘটক সবার কাছে প্রিয় তাঁর সৃজনশীল প্রতিভা, শ্রেণি-বৈষম্যহীন মানসিকতা আর পাগলাটে জীবন যাপনের জন্যে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ যে তাঁর মনে গভীর দাগ কেটে দিয়েছিলো তার প্রমাণ যেমন তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে, তেমনি তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র দেখেও এমনটা খুব সহজে বোঝা যায়। দেশভাগ মূলত তাঁর নিজেকে মাতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেছিলো। পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে নিজের দেশে চলাচল করা যে কতোটা অসম্মান আর লজ্জার, এই বোধ থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলাদেশে আসেননি ঋত্বিক ঘটক।
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ঠিকই, কিন্তু নিজ চোখে দেখতে পান মায়ের উদর হতে এক সাথে পৃথিবীতে আসা জমজ বোন প্রতীতি দেবীর বিধ্বস্ত সংসার। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রবধু ছিলেন প্রতীতি। ৭১ সালে বুদ্ধিজীবী ধীরেন্দ্রনাথকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। চোখের সামনে অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি আর বিধ্বস্ত নিজের বোনকে দেখে সেদিন আঁতকে উঠেছিল ঋত্বিক ঘটকের আত্মা! কিন্তু পাগলাটে ভাইয়ের বোনও যে কিঞ্চিৎ পাগলাটেই হবে তা আর বলতে!
এইসব প্রতি-পরিবেশে ভবি তাঁর ক্ষ্যাপাটে ভাই ভবার হাতে এনে দেন প্রায় অর্ধদগ্ধ অদ্বৈত মল্ল বর্মণের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। যা হাতে পেয়েই বুঁদ হয়ে পড়তে থাকেন ঘটক। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বোনকে উদ্দেশ্য করে খাতা-কলম আনতে বলেন ঋত্বিক। কিন্তু এই ভস্মীভূত ঘরে কলম পাওয়া গেলেও খাতা খুঁজে পাননি বোন ভবি। তাই নিজের একটি সাদা ধবধবে শাড়ি এনে দেন ভাইকে। আর পাগলাটে ভবা সারা রাত ধরে বোনের সাদা শাড়িতে লিখে চলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর চিত্রনাট্য…!
‘ভারতের সিনেমায় এখন পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে, ঋত্বিক তারচেয়ে দশ বছর এগিয়ে রয়েছেন। ঋত্বিক ইজ অ্যা গ্রেট মাস্টার অব ওয়ার্ল্ড সিনেমা।’- ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে এক বক্তৃতায় এমন অসাধারণ মূল্যায়ণ করেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য। যারা ঋত্বিককে জানেন, যারা তাঁর চলচ্চিত্র দেখেছেন, যারা তাঁকে অধ্যয়ন করেছেন, যে সকল তরুণ আজও ঋত্বিককে আত্মস্থ করায় মগ্ন আছেন তারা জানেন নবারুণ কি নিদারুণ সত্য বলেছেন!
ঋত্বিকের পরিচালনায় সিনেমাগুলি:
• নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭)
• অযান্ত্রিক (১৯৫৮)
• বাড়ি থেকে পালিয়ে(১৯৫৮)
• মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)
• কোমল গান্ধার (১৯৬১)
• সুবর্ণরেখা (১৯৬২)
• তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
• যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭)