স্ত্রী মারার যাবার পর ১২ বছর বয়সী ছেলে নিয়ে হতাশ হয়ে বেকার জীবন যাপন করছিলেন নওশাদ। একদিন পরিচয় হয় দেলু নামের এক হিজড়া ব্যক্তির সঙ্গে। নওশাদকে দেলু প্রলোভন দেখা, হিজড়া হলে অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। রাজি হন এক ছেলের বাবা নওশাদ। অপারেশন করে ছেলে থেকে মেয়ে হিজড়া হন। নাম পরিবর্তন করে হন চম্পা। দেলুর অধীনে কাজ করেন অন্তত পাঁচ বছর।
এরপর আশুলিয়ার এনায়েতপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন নওশাদ ওরফে চম্পা। সেখানে রাকিব হাসান শাওন নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। প্রেমের সম্পর্কও হয় দুজনে। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দুজন বসবাস শুরু করেন।
প্রেমিক রাকিবের খরচ বহন করতেন চম্পা নিজেই। একদিন টাকা চাওয়া দিয়ে দুজনের মধ্যে বিবাদ হয়। চম্পা জানতে পারেন, তার প্রেমিকের সঙ্গে অন্য হিজড়ার সম্পর্ক রয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হন চম্পা। শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন রাকিবকে। এরপর মরদেহ বস্তাবন্দী করে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যান। আশ্রয় নেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। সেখানে নিজেকে স্বপ্না পরিচয় দিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
২০২১ সালের ৭ জুন আশুলিয়ার এনায়েতপুর এলাকা থেকে একটি বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ।
থানা পুলিশ মামলাটি দু’মাস তদন্ত করে মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। পিবিআইর উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আনোয়ার হোসেন দায়িত্ব পেয়ে ঘটনাস্থল ও আশপাশে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন লাশ পাওয়ার পরের দিন চম্পা নামে তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি নিজের বাবার অসুস্থতার কথা বলে জামালপুর সদরে গেছেন।
ওই ঠিকানায় চম্পা হিজড়া নামে একজনের বাড়ি পাওয়া যায় তার নাম আগে ছিল নওশাদ। জানা যায়, আনুমানিক ২০ বছর আগে নওশাদের বাবা-মা মারা গেছেন এবং তিনি ঢাকায় বসবাস করতেন। মাঝে মধ্যে গ্রামে আসতেন। পরিবার না থাকলেও বাবার অসুস্থতার কথা বলে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চম্পা ওরফে নওশাদের ওপর সন্দেহ হয় এসআই আনোয়ারের।
তাকে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় রাকিব হাসান শাওন নামে একজনের ঠিকানা পাওয়া যায়। সেখানে যোগাযোগ করে জানা যায়, রাকিব ঢাকার আশুলিয়ায় এক হিজড়ার সঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু কোথায় থাকেন পরিবারের কেউ জানে না।রাকিবের নামে রেজিস্ট্রেশন করা একটি মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে তার বাবার কাছে জানতে চাইলে তিনি নম্বরটি রাকিবের বলে নিশ্চিত করেন। তবে, মরদেহের ছবি তিনি শনাক্ত করতে পারেননি। পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়, ঢাকার আশুলিয়ায় পাওয়া অজ্ঞাতনামা লাশটি রাকিবের।
এরপর চম্পা হিজড়াকে গ্রেপ্তার করতে জামালপুর, শেরপুর বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুরসহ গাইবান্ধা জেলার হিজড়া পল্লিতে ধারাবাহিক অভিযান চালানো হয়। চম্পা হিজড়া তার নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হিজড়া পল্লিতে আত্মগোপন করে আছেন, এমন তথ্য পায় পিবিআই। এরপর গত ১৭ অক্টোবর নওশাদ ওরফে চম্পা ওরফে স্বপ্নাকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। চম্পাও হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে চম্পা জানায়, ২০২১ সালের ১ জুন রাকিব তার কাছে ১ হাজার টাকা চান। না দেওয়ায় রাকিব তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। পরে প্রেমিকার কাছে ২০ টাকা চান রাকিব। চম্পা টাকা দিলে তিনি দুটি মাইলাম ট্যাবলেট কিনে খান। ট্যাবলেট কিনতে যাওয়ার আগে রাকিব তার মোবাইল বাসায় ফেলে যান। এ সময় রিপা নামে তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি ফোন করেন।
ফোনটি রিসিভ করেন চম্পা। জানতে পারেন, রিপার সঙ্গে রাকিবের প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। রাকিব বাসায় ফিরলে চম্পা তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ হয়। এক পর্যায়ে চম্পা তার প্রেমিক রাকিবের গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করেন। তারপর তিনি গুরুমা রুমি হিজড়ার বাসা থেকে চটের বস্তা নিয়ে এসে রাকিবের মরদেহ সেটিতে ভরে পাশের রুমে রেখে দেন। মরদেহটি কীভাবে গুম করবেন সে পন্থাও খুঁজতে থাকেন চম্পা।
গত ৭ জুন রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে চম্পা রাকিবের বস্তাবন্দী মরদেহ বাসার পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকেন। পরদিন স্থানীয় লোকজন মরদেহ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দেয়। এ সময় চম্পা পালিয়ে গিয়ে সুন্দরগঞ্জের হিজড়া পল্লিতে স্বপ্না নামে বসবাস শুরু করেন।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, গ্রেপ্তার চম্পাকে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে তাকে বিজ্ঞ আদালতে হাজির করা হয়েছিল। আদালত তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামি নওশাদ ওরফে চম্পা ওরফে স্বপ্না হিজড়াকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের বিষয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, যশোরের এক গ্রাম্য ডাক্তারের মাধ্যমে দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়ায় রূপান্তর করেন। ওই ডাক্তার এমন আরও অনেককেই হিজড়া বানিয়েছেন। তবে কতজনকে করেছেন তার তদন্ত চলছে। লিঙ্গ পরিবর্তন করতে তাকে ১০ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হয়। আর পুরো চিকিৎসায় তিনি নেন ১ লাখ টাকা। আর এই পুরো চক্রকে ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরই এক গুরু মা। দেলু হিজড়াকে ২২ অক্টোবর জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে।