চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিশাল বিক্ষোভ সত্ত্বেও ম্যাক্রো তার অবস্থান বদল করবেন না

ফ্রান্সে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছরে উন্নীত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবারও বড় আকারের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর সরকারের বিরুদ্ধে দু’সপ্তাহ আগে প্রথম দফায় ১১ লাখেরও বেশি মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। তবে এবারের বিক্ষোভে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবার আশংকা করছে বিশ্লেষকরা।

বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ম্যাক্রোর সরকার পেনশনের বয়সসীমা সংস্কারের পরিকল্পনা আগামী সপ্তাহে ফরাসি জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে উত্থাপন করবে। তবে সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৬৭ শতাংশ ভোটার এর সঙ্গে একমত নয়। প্রশাসনের বলছে, প্যারিসে ৮৭ হাজার ও দেশজুড়ে ২৮ লাখ মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তবে ট্রেড ইউনিয়নগুলো বলছে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ।

এত মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়া সত্তেও ম্যাক্রো তার অবস্থান থেকে সরে আসবেন কী না, সে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তবে সংস্কার কার্যক্রমের কিছু অংশে পরিবর্তন আনার আভাস দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে ম্যাক্রোর দলের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ফলে এই বিল পাস করাতে তাদের নিজ দলের আইনপ্রণেতাদের পাশাপাশি ডানপন্থী রিপাবলিকানদের সহায়তা প্রয়োজন হবে।

সাম্প্রতিক দেয়া সাক্ষাৎকারে ম্যাক্রো বলেন, অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এই সংস্কার আনা হচ্ছে। এর ফলে তিনি জনপ্রিয়তা হারালেও তা তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত। এই সংস্কারের পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলছেন, তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন পেনশন ভোগীর সংখ্যা ছিল এক কোটি, এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭০ লক্ষ।

প্যারিসে কারিমা (৬২) নামের একজন বিক্ষোভকারী বলেন, সরকারের এই উদ্যোগে নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের অনেকের চাকরি জীবনে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি এসেছে এবং এখন আমাদের পেনশন পেতে হলে আগের চেয়েও বেশি সময় কাজ করতে হবে।

১৯ বছর বয়স্ক আইন বিভাগের এক ছাত্রী এডেল বলেন, মনে হচ্ছে যেন কেউ আমাদের মুখে থুতু ছুঁড়ছে।এই পেনশন সংস্কার আইনে পরিবর্তন আনার অন্য পথও আছে। আসলে তিনি জনগণের কথা শুনতে চান না। এখানে গণতন্ত্রের স্পষ্ট অভাব রয়েছে।

দমকল বাহিনীর কর্মী ক্রিস্টফ মারিন বলেন, পেনশন সংস্কার নিয়ে যতক্ষণ না সরকার মত পরিবর্তন করছে ততক্ষণ আমরা আন্দোলন বন্ধ করব না।

রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ব্রুনো প্যালিয়ের বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অনেক ফরাসি মানুষ মনে করছেন কাজ করা আগের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে। এমন না যে তারা কাজ করতে চান না তবে তারা চলমান পরিস্থিতিতে কাজ করতে চাচ্ছেন না।

একজন পুরুষ নার্স বলেন, সরকারি হাসপাতালের পরিস্থিতি অসহনীয়। এ জন্য তিনি বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। এছাড়াও, শিক্ষকরাও স্কুলের পরিস্থিতি নিয়ে খুশি নয়।

ফ্রান্সের অবসরগ্রহণের বয়সসীমা ৬২। ইউরোপের অনেক দেশেই অবসরের বয়স ৬৪ এর চেয়ে বেশি৷ ২০২৪ সাল থেকে জার্মানিতে অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৬৭ বছর হবে। জার্মানির মতো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশেই যেখানে অবসরের বয়স ৬৭, সেখানে অবসরের বয়স ৬৪ করতে চাওয়ায় ফ্রান্সে এত বিক্ষোভ কেন?

জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউটের গবেষক উলরিশ বেকার মনে করেন পেনশন নীতিমালা বিষয়টা এতটাই জটিল যে এক দেশের পেনশনের সঙ্গে অন্য দেশের তুলনা সবসময় যথার্থ হয় না। পেনশনের তুলনা করা খুব কঠিন কারণ বিষয়টি একেক দেশে একেক রকম৷ তারপরও এখন তুলনাটা এসে যাচ্ছে।

তার মতে, ফ্রান্সে বিক্ষোভ হচ্ছে বলেই অন্য দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের পেনশন নীতিমালার তুলনাটা এখন বেশি করে হচ্ছে৷

ফ্রান্সে বিক্ষোভ শুরুর মূল কারণ হচ্ছে সবচেয়ে আগে অবসর নেয়ার ন্যূনতম বয়সটা সরকার কেন বাড়াতে চাইছে। এতদিন সব মিলিয়ে সাড়ে ৪১ বছর কাজ করলেই অবসর নেয়া যেত৷ কিন্তু নতুন এই উদ্যোগ কার্যকর হলে অন্তত ৪৩ বছর কাজ করলে পেনশনের পাওয়া যাবে৷ তার চেয়ে কম করলে কিছু টাকা কাটা যাবে।

জার্মানিতে অবসরের বয়স ৬৭ হলেও কেউ সব মিলিয়ে ৪৫ বছর কাজ করলে এবং তখন তার বয়স ৬৩ বছর হলেই তিনি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাসহ অবসর নিতে পারেন এবং কোনো টাকাও কাটে না সরকার৷ জার্মানির চাকরিজীবীরা আয়কর কাটার পর অবশিষ্ট বেতনের ৫২ দশমিক ৯ ভাগ পেনশন পেয়ে থাকেন। তাতে যে টাকা আসে তার থেকে অন্তত ৫৪০ ইউরো বেশি পান ফরাসিরা।

তবে সরকারের পরিকল্পনা কার্যকর হলে ফরাসিদের সেই টাকাটা কমবে। কারণ সরকার অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি ন্যূনতম যত বছর কাজ করলে পেনশন পাওয়া যায়, সেই বয়সটাও বাড়াচ্ছে৷ এর ফলে বেশি ক্ষতি হবে কম বেতনের কর্মচারীরা৷ এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দিতে  অবশ্য ন্যূনতম পেনশনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে ফরাসি সরকার৷ এতদিন সেই অঙ্কটা ছিল ৯৬১ দশমিক ৮ ইউরো। এখন সেটা বেড়ে হবে ১২০০ ইউরো৷

এদিকে বিক্ষোভের কারণে ফ্রান্সের পরিবহন খাত বড় আকারে বিঘ্নিত হয়েছে। প্যারিসের বাইরে প্রায় ৭৫ শতাংশ পূর্বনির্ধারিত ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেনি। প্যারিসে শুধুমাত্র সু’টি চালকবিহীন মেট্রো লাইন চালু রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা তেলের পাম্পে ধর্মঘট ও সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো কঠোর কর্মসূচীর কথাও ভাবছে।

বিক্ষোভের সময় বহু জায়গায় অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বোর্দো শহরের ঐতিহাসিক পৌর ভবনের দরজায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় ২০০ শহরজুড়ে আয়োজিত এই বিক্ষোভে প্রায় ১১ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়।

ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন বলেছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৪৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৪১ জন সদস্য আহত হয়েছে। রাজধানী প্যারিসের রাস্তাতেই ৯০৩টি অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, বোর্দো শহরের ঐতিহাসিক টাউন হলে কে আগুন লাগিয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। তবে দমকল বাহিনী কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

প্যারিসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সবার এখন একটাই লক্ষ্য। সরকারের এই নতুন পরিকল্পনা থেকে সরে আসা। চলতি সপ্তাহেই হয়ত ম্যাক্রোকে এই বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বিক্ষোভ হয়ত আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।