নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার বাউশি ইউনিয়নের ছালিপুরা গ্রামের বাসিন্দা, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বারহাট্টা শাখা সংসদের সদস্য নির্মল কুমার বর্মণের মেয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুক্তি রাণী বর্মণের হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
মুক্তি রানী বর্মণ হত্যার প্রতিবাদে বৃহিস্পতিবার ৪ মে বিকাল ৫টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে এ দাবি জানান বক্তারা।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশের শুরুতে দলীয় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমামের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম, সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, সহসাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মাহফুজা খানম, নারী প্রগতি সংঘের ম্যানেজার সেলিনা পারভীন, প্রীতিলতা ব্রিগেডের সংগঠক সুমাইয়া সেতু, সিপিবি নারী সেল’র নেত্রী লুনা নূর, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক আকরামুল হক, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান শহিদ প্রমূখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, মুক্তি রানী বর্মণের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আরো একবার সমাজে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী মানসিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। উদীচী বারহাট্টা শাখার একজন প্রতিভাবান, প্রতিশ্রুতিশীল ও উদীয়মান কণ্ঠশিল্পী ছিল মুক্তি রানী বর্মণ। পাশাপাশি নারী প্রগতি সংঘের সাথে যুক্ত হয়ে সমাজের নারীদের শোষণ, বঞ্চনা দূর করার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল সে। কিন্তু সমাজের নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছে তাকে। মুক্তিকে যে হত্যা করেছে সে নিজেও একজন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণ। এই বয়সী একজন তরুণকে হত্যাকারী হিসেবে তৈরি করেছে যে সমাজ ব্যবস্থা সেই সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন সমাবেশের বক্তারা।
তারা বলেন, মুক্তির হত্যার জন্য এই সমাজ, রাষ্ট্র কেউই দায় এড়াতে পারে না। অতীতে তনু, নুসরাত, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি বা আরও অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে এই রাষ্ট্র। আর সেজন্যই এমন ঘটনা ঘটাতে সাহস পায় কাউসারের মতো খুনীরা। যে রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে থাকে, সে রাষ্ট্রে মুক্তির মতো এমন কিশোরী বা নারীরা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেই থাকবে। বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজারো নারী এমন হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে সমাবেশে দাবি করেন বক্তারা।
এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না মন্তব্য করে বক্তারা বলেন, ভবিষ্যতে আর কোন মুক্তি রানী বর্মণ যেন হারিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে সচেতন হলে অবশ্যই এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
সমাবেশে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন হচ্ছে। গাছপালা কেটে, জলাশয় ভরাট করে ফ্লাইওভারসহ হাজারো স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের মানবিক উন্নয়নের দিকে কোন নজর দেয়া হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তক থেকে নারীর সমতা, নারীর প্রতি সম্মানসূচক, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন সব লেখাগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানে বাউল গান, যাত্রাপালা বা লোকসংস্কৃতির কোন অনুষ্ঠান করতে গেলে নানা ধরনের অনুমতি বা বিধিনিষেধের বালাই দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। অথচ এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। আর এর মাধ্যমেই ভবিষ্যতে মুক্তি রানী বর্মণদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। এসময় তিনি বিচারহীনতার সংস্কৃতির উদাহরণ হিসেবে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার বিচার না হওয়ার কথা তুলে ধরেন।
সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, আশার কথা হলো, দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে মুক্তির হত্যাকারী কাউছারকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তবে, কাউসারের সঠিক বিচার নিশ্চিত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তারা। কেননা, অতীতেও আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খুনীর পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাই তারা বলেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে কাউছারের সাথে যারা সহযোগী হিসেবে ছিল তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বা আইনের ফাঁকফোকর গলে কোনভাবেই যেন খুনী পার না পেয়ে যায়, তাও নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।