বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত পক্ষকালব্যাপী দেশের রাজনীতি ছিল উত্তপ্ত। কী হতে যাচ্ছে ১০ ডিসেম্বর সবার মনে ছিল এই কৌতুহল।
বিএনপির শীর্ষ কয়কজন নেতা বলে রেখেছিলেন ১০ ডিসেম্বর সরকারের পতন হবে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ক্ষমতা দখল করে নেবেন। বিশেষ করে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমান ৮ অক্টোবর রাজধানীর ডিআরইউ মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। অন্য কারো কথায় না। (সূত্র-বাংলা নিউজ)।
এর পর ১০ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে এক সমাবেশে দলটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ঘোষণা করেন “খুব শিগগিরই তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসবেন। কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না। (সূত্র-বিডি নিউজ)।
বিএনপির ছোট বড় মাঝারি নেতাদের এমন বক্তব্য চলতেই থাকে। সমানতালে চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে নানা গুজব। আর এসব গুজবে স্বভাবতই রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। মূলত বিএনপি নেতাদের এমন বক্ত্যব্যের পরই নড়েচড়ে বসে সরকার। দেশবাসী বিশেষ করে রাজধানীবাসীর মনে অজানা আতঙ্ক দেখা দেয়। একদিকে সরকারের কঠোর অবস্থান অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের সরকার পতনের দিন তারিখ ঘোষণা করার পর রাজনীতি আবার সংঘাতের দিকে যাচ্ছে এমন আশংকা দেখা দেয়।
বিএনপি ১০ ডিসেম্বর দলের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি চায়। পুলিশ তাদের সেখানে অনুমতি দেয়নি। বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলা হয়। কিন্তু বিএনপি সেখানে যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। এ নিয়ে নানা নাটকীয়তা, নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে মারামারি, সংঘাতে একজনের মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশে যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেখানে ঢাকার সমাবশে তিনি যোগ দিতে পারেন নি। তার আগে আগেই তাকে জেলে পুরা হয় নয়া পল্টনে পুলিশের সঙ্গে মারামারির মামলায়। ফলে ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এবং কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন । এই সমাবেশে তিনি ১০ দফা ঘোষণা করেন। সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচিও দেন।
সমাবেশ থেকে ঘোষিত ১০ দফা নিয়েই গত কয়কদিন ধরে চলছে রাজনীতিতে নানামুখি আলোচনা। কেউ বলছেন ১০ দফার মধ্যে নতুন কিছু নেই, সবই পুরোনো। এসব দাবি নিয়ে বিএনপি গত কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন করে আসছে। আবার কেউ বলছেন এই ১০ দফার মধ্যে এমন কয়েকটি দফা আছে যেগুলো বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নিজেরাও বাস্তবায়ন করবে না। আর এসব দাবির সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বা জনস্বার্থ কতোটুকু অর্থাৎ জনগণের লাভ ক্ষতি কী তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বিএনপির এই ১০ দফা পর্যালোচনা করে কী পাওয়া যায় তাই এবার দফাওয়ারি আলোচনা করা যাক।
গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশ থেকে বিএনপি যে ১০ দফা ঘোষণা করে হলো তার প্রথমটি হলো; “বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।’
এ দাবিটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটি বিএনপির পুরোনো দাবি এবং এই দাবিতে তারা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছে। আর এটাকে জনদাবি বলা যাবে না। কারণ যে প্রক্রিয়াতেই হোক ভোটের মাধ্যমে এই সংসদ হয়েছে। আর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সংসদ বিলুপ্ত করার দাবি বিএনপির রাজনৈতিক দাবি। এর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা কতোটুকু তা ভাবতে হবে।
বিএনপির দ্বিতীয় দফা দাবিতে বলা হয়েছে, “১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।”
এটাও মিমাংসিত ইস্যু। কারণ ২০১১ সালের ১০ মে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ, তত্বাবধায়ক সরকার তথা সংবিধানের ৫৮খ অনুচ্ছেদ অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করে। ফলে এই ইস্যু নিয়ে সরকারের করার কিছু নেই। এটা পুনঃস্থাপন করতে হলে আবার আদালতে যেতে হবে। রিভিউ করার আবেদন করা যেতে পারে। কাজেই এ দাবিটিও বিএনপি সরকারের কাছে করতে পারে না। করলে আদালতের কাছে করতে পারে।
তৃতীয় দফায় বিএনপি বলেছে”, নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, ওই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা।”
বিএনপির এই দাবির রাজনৈতিক যৌক্তিকতা আছে। তবে কথা হলো যে দল ক্ষমতায় যায় সেই ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগও একই ধরণের দাবি করেছিল। নির্বাচনের জন্য অবশ্যই লেভেল প্ল্যায়িং ফিল্ড দরকার । বিএনপির এটা দলীয় দাবি। এর সঙ্গে জনস্বার্থের সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে।
চতুর্থ দফায়, খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি, দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা, সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার না করার দাবি জানানো হয়েছে।।
এটাও বিএনপির দলীয় দাবি। এর সঙ্গে জনদাবির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঢালাওভাবে সাজা বাতিলের কোনো যুক্তি হতে পারেনা। যদি কেউ মিথ্যা মামলার শিকার হয় তা হলে অবশ্যই এর বিহিত হওয়া দরকার। মিথ্যা বা প্রতিহিংসার মামলায় কোনো নাগরিককে হয়রানি করার এখতিয়ার সরকারের নেই। আর গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে সরকার অবশ্যই বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।
পঞ্চম দফায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করার দাবি জানানো হয়েছে।
বিএনপির এই দাবিটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলা যায়। কিন্তু হলফ করে এটাও বলা যায় যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এই দুই কালাকানুন বাতিল করবে না। কারণ এর আগে বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় ছিলো কিন্তু তারা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করে নি। ভবিষ্যতেও বাতিল করবে না। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের সৌজন্যতা বিএনপি দেখাবে তাও ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এর আগে বিএনপি আমলে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন আইন করা হয় এবং এ আইনে নির্যাতন চালানো হয় বিরোধীদের ওপর। সন্ত্রাস দমন আইন বাতিলের জন্য অনেক দাবি জানানো হয়েছিল কিন্তু তা বাতিল করেনি। বরং এটা কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছিল।
ষষ্ঠ দফায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
বিএনপির এ দাবিটাও যৌক্তিক ও জনদাবি। এর সঙ্গে আমিও একমত। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এটা বাতিল করবে না কোনো সরকারই। কারণ এর সঙ্গে রাষ্ট্রপরিচালনায় সরকারের আর্থিক বিষয় জড়িত।
সপ্তম দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে বিএনপির এই দাবির সঙ্গেও আমি একমত এবং এটা জনদাবি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মাত্রাতিরিক্ত দাম জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে। বাজারে কোনো জবাবদিহিতা নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। কিন্তু এই ধরনের সিন্ডিকেট নতুন নয়। সব সরকারের আমলেই সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকে। বিএনপি আমলেও সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। কাজেই বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সিন্ডিকেট থাকবে না, দ্রব্যমূল্য কমবে এটা সোনার পাথরবাটির মতো মনে হয়।
অষ্টম দফায়, বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন এবং দুর্নীতি চিহ্নিত করে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা হয়েছে।
এটাকেও জনদাবি বলবো। তবে এটা নতুন কোনো দাবি নয়। গত তিন দশক ধরেই দেশের মানুষ এ দাবি জানিয়ে আসছে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, শেয়ার বাজার লুট হয়েছে তা তদন্তের জন্য কমিশন গঠন হতেই পারে। তবে সেটা শুধু আওয়ামী লীগ আমলেই হয়েছে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বিএনপি আমলেও একই অপরাধ ঘটেছে। কাজেই শুধু আওয়ামী লীগ আমলে সংগঠিত অপরাধের বিচার চাইলেই হবে না, বিএনপি জামাত আমলে সংগঠিত অপরাধের বিচারও হতে হবে। একপক্ষের বিচার কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নবম দফায় গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়েছে।
এটাও জনদাবি। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে এই দাবি শোভা পায় না। কারণ গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা বিএনপি আমলে কোনো অংশে কম হয় নি। আর ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের ওপর নির্যাতন এখন যেমন হচ্ছে বিএনপি আমলেও তেমন হয়েছে। বরং বেশি হয়েছে। কোনো ঘটনারই বিচার হয় নি। সরকারও বিচার করার উদ্যোগ নেয়নি, বিচার বিভাগও বিচার করেনি। কাজেই এসব দাবি শুধু দলের কাগজপত্রেই লেখা থাকে। বাস্তবে কার্যকর হয় না।
দশম দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। এসব দাবির পেছনে যুক্তি থাকলেও বাস্তবে কার্যকর হয় না। সব সরকারের আমলেই আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে, বিচারবিভাগও সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সরকারের ইশারা ছাড়া কেউ কাজ করতে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এবং বিএনপির ঘোষিত ১০ দফা পর্যালোচনা করে এটা বলা যায় এসব দাবির কোনোটাই নতুন কিছু নয়। বরং নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো।
তাই বলা যায় জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলন করে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে সরকার পতন সম্ভব নয়। তার চেয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার বিএনপির নীতিনির্ধারকদের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)