বিশ্ব মুসলিম মানসচিত্তে মাহে রমজান একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত নাম। এ মাস আসে বান্দার বহু কল্যাণের খাজানা নিয়ে। যাতে আছে মানুষের নানাবিধ উপকারিতার সুযোগ। দৈহিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নে মাহে রমাজানের সিয়াম সাধনায় আছে এক অভাবনীয় কার্যকারিতা। মাসব্যাপী রোজা রাখার ফলে বান্দার পাপরাশি ঝরে পড়ে মৃতপ্রায় বৃক্ষ থেকে নিরুপায় হয়ে পতিত হওয়া পাতাপল্লবের ন্যায়। একইভাবে রোজা পালনে আছে আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য যথাযথ প্রতিষেধ।
ঐশি গ্রন্থ আল কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতের শেষপ্রান্তে একটু ঘুরে আসি মহামহিম আল্লাহর বাণী, “আর যদি তোমরা রোজা রাখো তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণময়, যদি তোমরা বুঝতে পারো”।
এবার আমরা জানবো মাহে রমজানুল মুবারকে সারা মাস রোজা রাখার দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উপকরিতার সম্পর্কে। চলুন, প্রথমে জেনে আসি রোজা রাখলে আমাদের শরীরে কী ধরনের উপকারিতা লাভ করতে পারি।
শেরে খোদা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে রসুলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেন, ’দয়াময় আল্লাহ বনী ইসরাইলের কোনো একজন নবির প্রতি ওহি প্রত্যাদেশ করেন হে নবি! আপনার উম্মতদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দিন কেন বান্দা আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে একদিন রোজা পালন করবে, অবশ্যই আমি আল্লাহ তার শরীর সুস্থ রাখব এবং তার প্রতিদান বহুগুণ বাড়িয়ে দেব।’
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে এতে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। এই আধুনিক বিজ্ঞানও ইসলামের প্রতিটি বিধানে নানা দিক কল্যাণ প্রমাণ করেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ হলো রোজা।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বলছে, রোজা মানবদেহের জন্য প্রভূত কল্যাণের ধারকবাহক। ২০১৯ সালে লন্ডনের পাঁচটি মসজিদে ‘লন্ডন রামাদানস স্টাডি শিরোনামে’ একটি গবেষণা হয়। রমজানের আগে-পরে ব্লাড প্রেসার মেপে দেখা যায় কোনো পরিবর্তন আছে কি না? দেখা গেল সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার তথা ব্লাড প্রেসারের ওপরের সংখ্যাটা কমেছে সাত মিলিমিটার মার্কারি আর দ্বিতীয় সংখ্যাটি তিন মিলিমিটার মার্কারি কমে গেছে। ভারত, পাকিস্তান, কাতারসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় গবেষণায় উঠে এসেছে, রমজানের রোজায় ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আসে ওজন না কমলেও। ইফতার ও সাহরিতে বেশি বেশি ফলমূল খেলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা আরো সহজ হবে বলে মনে করেন গবেষকগণ।
রোজা বুকব্যাথা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি এবং চর্মরোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী একটি প্রেশক্রিপশন। অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের মতর, রোজার ফলে রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে। তা ছাড়া রোজা রাখার কারণে স্ট্রেস হরমোন করটিসেলের নিঃসরণ কমে। এতে বিপাকক্রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। রোজার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে বিধায় মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়, কর্মোদ্দীপনাও বাড়ে, যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। অধিকাংশ হাঁপানি রোগীর ক্ষেত্রেই রোজা উপকারী। রোজার মাধ্যমে চর্মের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো অকার্যকর হয়ে যায়।
ডায়াবেটিস আমাদের শৈশবরোগ বললেই চলে। আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, ডায়াবেটিস পতিরোধে পরিমিত, সমানুপাতিক এবং স্বল্প খাবার গ্রহণের বিশাল সহযোগিতা রয়েছে। যা পুরো বছরজুড়ে রজমান মাস ব্যতীত মেনে চলা সম্ভব নয়। তাই মাহে রমজানে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং প্রতিষেধনে আমাদের অপার সুযোগ হাতছানি দিয়ে যায়। এ মাসে অধিকহারে ধুমপান থেকে বিরত থাকার কারণে ফুসফুস দীর্ঘসময় পর্যন্ত নিকোটিনের বিষক্রিয়া মুক্ত থাকে। ফলে ফুসফুস রোগমুক্ত থাকে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে। ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
রোজার শারীরিক উপকারিতার পাশাপাশি আত্মবিকাশের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। দীর্ঘক্ষণ বুভুক্ষু থাকার কারণে দুষ্ট আত্মার অভয়ারণ্যে ঐশি হামলা আসে বারবার। মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং আধ্যাত্মিক সফলতার পথ সুগম হয়। যাবতীয় পানাহার থেকে মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ পবিত। বান্দা যখন সারাটাদিন না খেয়ে, পান না করে এবং জৈবিক চাহিদা পূরণে থেকে নিজেকে সংবরণ করে, তখন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপযোগী হয়। মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ মুমিনজীবনে নিয়ে আসে দেহ ও মনের পবিত্রতা। সিয়াম সাধনায় আছে এক বিশেষ পরীক্ষা। যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকটভাজন হওয়ার বাছাই পর্ব হিসেবে বিবেচিত।
মাহে রমজানের আগমনের মধ্য দিয়ে মুসলিম জীবনে সূচিত হয় নব আয়োজন, নব আনন্দ, নূতন ব্যবস্থাপনা। পয়লা রাতে মহামহিম আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি বিশেষভাবে রহমতের দৃষ্টি প্রদান কররন এ মাসে। রোজাদার সদ্যভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকের ন্যয় পাপমুক্তির পয়গাম খোঁজে পান। কলুষমুক্ত হওয়ার একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে রোজা অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম হজরত গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘ দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সংযমের সঙ্গে যখন অন্তরের সাধনা যুক্ত হয়, তখন আদর্শ সংযমের চেতনা শ্রেষ্ঠতার প্রতিফলিত হয়, রমজানের সিয়াম সাধনায়।’
সামাজিক বন্ধন, সম্প্রতি-ভ্রাতৃত্ববোধ ও বিশ্বে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে রোজা গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামত। মুসলিম বিশ্বে পুরো মাসটি যেন রহমতের ফুলধারায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে। রোজায় বিশ্বের বড় বড় ধনী ব্যক্তি, রাজা-বাদশাহ-আমির একসঙ্গে ইফতার, সেহরি, তারাবি, জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এমন সাম্যের ছবি ভেসে উঠে সমগ্র দুনিয়ায়।