রাজধানীর কদমতলীতে প্রায় ৬ বছর আগে জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটনের দাবি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর কদমতী থানাধীন ‘কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস’-এর মেসে খুনের ঘটনাটি ঘটে।দীর্ঘ তদন্ত শেষে জোড়া খুনে জড়িত কথা এন্টারপ্রাইজের কর্মচারীসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে পিবিআইয়ের ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘ভিকটিম সোহেল মিয়া টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। ভিকটিম সোহেল প্রতিবেশী চাচা আসামি ইকবাল হোসেনসহ ঢাকার কদমতলী থানাধীন কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসে চাকরি করতেন। উক্ত এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী হাসান মিয়া ইকবালের স্ত্রী পারভীন বেগমের (৪০) মোবাইলে ফোন করে জানায় যে, গত ৬ নভেম্বর ২০১৭ সালে রাত ৩টায় কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসের মেসে ভিকটিম ইকবাল তার প্রতিবেশী ভাতিজা সোহেলকে লোহার রড দিয়ে মারপিট করে আহত করে পালিয়ে গেছে।
‘প্রেসের মালিক ও কর্মচারীরা সোহেলকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পান্থপথের ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনায় সোহেলের ছোট ভাই সাইদুর রহমান (২৮) বাদী হয়ে আসামি ইকবালের (৫৫) বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় মামলা করেন।’
তিনি বলেন, ‘কদমতলী থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৮ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখ সোহেল মারা গেলে ভিকটিম সোহেলের ছোট ভাই বাদী সাইদুর রহমান (২৮) আদালতে আবেদনপূর্বক তার দায়ের করা মামলায় পেনাল কোড আইনের ৩০২ ধারা সংযোজন করেন।’
পিবিআই জানায়, সোহেল হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ইকবাল ও সোহেল সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। তারা একই সঙ্গে প্রেসে চাকরি করতেন এবং রাতে একসঙ্গেই প্রেসের মেসে থাকতেন।
পিবিআই প্রধান জানান, ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর রাত ৩টার দিকে লাইট বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে সোহেল ও ইকবালের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইকবাল প্রেসে থাকা লোহার ভারী পাত দিয়ে মাথায় আঘাত করে আহত করেন সোহেলকে। পরে সোহেলের চিৎকারে প্রেসে থাকা অন্য কর্মচারীরা লাইট জ্বালালে ইকবাল লোহার পাত হাত থেকে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যান।
সোহেলকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পান্থপথের ইউনি হেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোহেলের মৃত্যু হয় ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর।
তদন্তকালে থানা পুলিশ সোহেল হত্যা মামলার বাদীর মাধ্যমে জানতে পারেন, মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি ইকবাল নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের বরপা বিক্রমপুর স্টিল মিলের বাউন্ডারি দেয়ালের পাশে গাছের সঙ্গে গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।
পিবিআই জানায়, সোহেলের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর মেসের অন্য কর্মচারীরা জানান, আসামি ইকবাল উপায় না দেখে নিজ অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন। আসামি ইকবাল আত্মহত্যা করেছে শুনে তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেয় পুলিশ। কোনো তদবির না থাকায় আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ করে।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইপ্রধান বলেন, রূপগঞ্জ থানা পুলিশ সোহেলের চাচা ভিকটিম ইকবালের মোবাইল থেকে তার পরিবারের লোকজনকে ফোন করে জানায় যে, বরপা বিক্রমপুর স্টিল মিলের বাউন্ডারির দেয়ালের পাশে গাছের সঙ্গে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ইকবালের লাশ পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে ভিকটিমের স্ত্রী ও ভাতিজা রূপগঞ্জ থানায় গিয়ে ইকবালের অর্ধগলিত লাশ শনাক্ত করে।
এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানার অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা উল্লেখ থাকায় ভিকটিম ইকবালের স্ত্রী বাদী হয়ে প্রেসের ১০ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন।
রূপগঞ্জ থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারনামীয় ১ থেকে ৬ নম্বর আসামিকে গ্রেপ্তার করেন। থানা পুলিশ তদন্ত করাকালে পুলিশ সুপারের নির্দেশে সহকারী পুলিশ সুপার ‘গ’ সার্কেল নারায়ণগঞ্জ মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি আগে গ্রেপ্তার করা আসামি ছাড়াও প্রেসের আরও দুই কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেন।
তদন্ত চলাকালে ২০১৮ সালের ২২ মে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।
পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জমান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি আগে গ্রেপ্তার করা এজাহার বহির্ভূত আসামি জাহানুর ও মো. জামালকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা কোনো তথ্য দেননি।পরে জ্যেষ্ঠ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মামলার বিষয়ে আলোচনায় তিনি দিকনির্দেশনা পান যে, আসামিরা কোনো গাড়ির সাহায্যে লাশটি রুপগঞ্জের বরপায় নিয়ে যেতে পারে।
তদন্তকারী দল ওই কারখানার নিরাপত্তা ও ড্রাইভিং কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এলাকায় কয়েকটি গাড়ির চলাচল সন্দেহ হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ধোলাইখাল থেকে একটি গাড়িসহ নুর আলমকে (৩৫) আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, ২০১৭ সালে তিনি বাদল মিয়ার পিকআপ চালাতেন। তিনি বাদলকে পিকআপসহ আসতে বললে বাদল তা করে।
নুর গাড়িটি এবং মালিক বাদলকে শনাক্ত করেন। পরে নুর ও বাদলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা লাশ গুম করার কথা স্বীকার করেন এবং প্রেসের কর্মচারীদের হাতে খুনের তথ্য দেন।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের ডিআইজি (পূর্বাঞ্চল) মোর্শেদুল আনোয়ার খান, পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম এবং পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (দক্ষিণ) পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।