মাথাভর্তি শুভ্র চুল আর সাদা পাঞ্জাবির ছয় ফুট দৈর্ঘের নায়কটির আর দেখা মিলবে না। কর্পোরেট পৃথিবীতে জীবন ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের গভীরে গিয়ে কে আর শোনাবেন অমৃত বাণী? সবাই যখন ঝিমিয়ে পড়ছে কিংবা মিশে যাচ্ছে বেনিয়াবৃত্তির ঘোলাজলে সেখানে বৈষয়িকতা ছাড়াও জীবনের বড় এক দায় তুলে ধরে নতুন কিছু দেখবার ও দেখাবার পথটি আর কে উন্মুক্ত করবেন? একে একে বাতি নিভে যাচ্ছে। পঙ্কজ ভট্টাচার্যও চলে গেলেন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও মুক্তি সংগ্রামের এক চির বিপ্লবী, শুদ্ধাচারী, মানবিক ছায়াবৃক্ষ সরে গেলেন। তার জ্বালানো আগুন রয়ে গেল বহু মানুষের গভীরে, বাংলাদেশের রোদ্র-ছায়ায়।
আজ আমি পঙ্কজ দা’কে নিয়ে লিখতে পারবো না। আজ সবকিছু অসংলগ্ন হয়ে যাবে। এলোমেলো হবে। আজ আমি যা কিছু লিখবো, সেটি পঙ্কজ দা দেখতে পাবেন না। হয়তো পরপারে থেকে জানবেন অনেক কিছু, আমি তার কিছুই জানতে পাবো না। তিনি সামনে থাকলে কোনো একটি কাজ যেমন হয়েছে, তার অনুপস্থিতিতে সে কাজটি তেমন হবে না। তার মতো এমন রুচিশীল মানবদরদীর উদার উপস্থিতির বাংলাদেশ আর তার অনুপস্থিতির বাংলাদেশের মধ্যে অনেক ফারাক। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের অংশ। যখন একদল ঋদ্ধ ঝলমলে মানুষ বাংলাদেশকে অনন্য আলোর উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে রাখতেন, আমি তাদের দেখেছি। পীর হাবিবুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত, অজয় রায়, ড. অজয় রায়, খান সারওয়ার মুরশিদ, তারেক আলী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, ড. আনিসুজ্জামান, রণেশ মৈত্রের মতো মানুষের দল। আরো অনেকেই ছিলেন। তারা আগে-পরে একে একে চলে গেছেন। পঙ্কজ দা বিপ্লবের ঝাণ্ডা হাতে পঞ্চান্নহাজার পাঁচশত আটানব্বই বর্গমাইলের বাংলাদেশকে বুকের ভেতর আগলে শক্তি ও আলো ছড়াচ্ছিলেন।
আমার তথা আমাদের (আমি ও লাইলা খালেদা) জীবনে এই বিপ্লবীর সাহচর্য ছিল নিবিড় এক আলোকস্পর্শের মতো। সহস্রাব্দের শুরু থেকে তার সঙ্গে নিয়মিত আলাপচারিতা আর নিবিড় সান্নিধ্য আমাদের জীবনকে ধন্য করেছে। মঙ্গলাবৃত করেছে। আমরা জীবনের মুক্তি চিনেছি তার কাছ থেকে। আমরা গণ মানুষের রাজনীতি বুঝেছি তার কাছ থেকে। মাটিঘেঁষা তৃণমূল হয়ে পুরো দেশকে মাথায় রাখার সাহসিকতার পাঠ আমরা তার কাছ থেকে নিয়েছি।
লাইলা পঙ্কজ দা’র রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল। আমি লাভ করেছিলাম সন্তানতূল্য স্নেহ আর বিপুল অধিকারের এক সাহচর্য। এই সম্পর্ক শ্রদ্ধা স্নেহের গণ্ডি পেরিয়ে বহুদূর ছড়িয়েছিল। আমরা যখন একটি দৃষ্টভঙ্গির প্রার্থনায় আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম, তখন পঙ্কজ দা’র কোনো অভিজ্ঞতাপ্রসূত বাক্য আমাদের পূর্ণ করে দিত। আমরা মানুষের বৈষয়িক সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে মুক্তির নেশায় জীবনের আলাদা এক পথ খুঁজে পেতাম।
পঙ্গজ দা’র বিপুল রাজনৈতিক পরিচয়। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বিপ্লবী সংগঠক, এক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেছিলেন তিনি। আজকের অনেক রাজনীতিক সত্যমিথ্যা মিলিয়ে প্রতিশ্রুতি আর বাক্যবাজি নিয়ে মানুষকে জিম্মি করার যে রাজনীতি করেন পঙ্কজ দা ছিলেন তার বিপক্ষে এক গভীর আস্থার নাম। তিনি রাজনীতি করতেন চেতনায়, লেখনীতে নিজের তৎপরতা দিয়ে। তিনি রাজনীতি করতেন নিজেকে শ্রম ও নিষ্ঠার শীর্ষে রেখে। তিনি রাজনীতি করতেন কর্মী সমর্থকদের অবাক করে দিতে।
আমাদের বাকি জীবন পঙ্কজ দার বিপ্লবী জীবনের সৌরভ অনুভব করবে। পঙ্কজ দা এদেশের রাজনীতিতে এক অবিকল্প নক্ষত্র হয়ে থাকবেন।
কয়েকমাস আগের কথা বলছি। ফুসফুসের অনিরাময়যোগ্য সংকট নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। শরীরের অঙ্গের মতোই তার সঙ্গে যোগ হলো নিঃশ্বাস সহায়ক যন্ত্রপাতি। সারাক্ষণ নাকে নল লাগানো থাকে। ফোনে আমাদের সঙ্গে কথা হয়। কণ্ঠস্বরে সেসব শ্বাসযন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কথা বলেন একই দৃঢ়তায়। ফেব্রুয়ারির শেষে একদিন ভিডিওকলে আমি জিজ্ঞেস করলাম দাদা এখন কেমন আছেন? বললেন, “আমি আর দশজনের তুলনায় অনেকটাই ভালো আছি। মনের যে শক্তি কাজ করে, সেই শক্তি বলে আমি নিজেকে রুগ্ন বা অসুস্থ ভাবি না। অপারেশন টেবিলেও আমি হাস্য রসিকতা করি। ডাক্তারকে বলেছি, আমাকে পিও ডব্লিউ নাম্বার ওয়ান বেডে কেন রাখলেন? আমি কি ‘প্রিজনার অফ ওয়ার’ ? তারা হেসে বলেন, না ‘পেশেন্ট অফ ওয়েটিং’। হাসপাতালে আমি হাসি ঠাট্টা করি। কষ্টটাকে মেনে নিই। কারণ, ঘুরে দাঁড়াবার একটা স্বভাব আমার মধ্যে আগেও ছিল, এখনও আছে। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ক্রিয়াশীল থাকার একটি প্রচেষ্টা আমার জন্মগত। এটি আমার নিজের ভেতর থেকে আয়ত্ব করা ক্ষমতা। সেদিক থেকে আমি আট দশজনের চেয়ে ভালো আছি। লিখতে পারি পড়তে পারি, নিজের কাজ করতে পারি। মিটিং করতে পারি। আর কি চাই? পঙ্কজ দা বললেন, আমি কোনো কথাবার্তায় এখন সেলফ সেন্সরশীপ করি না। কারণ, আমার যে বয়স, এই বয়সে আমাকে কেউ জেলে পুরবে না। এতে তাদেরই বিড়ম্বনা বাড়বে। খরচ বাড়বে। সেই হিসেবে এই সময়ে আমি দ্বিধাহীন।”
পঙ্কজ ভট্টাচার্যর ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের আইনজীবী। তাদের চট্টগ্রাম রাউজানের নোয়াপাড়ার বাড়িতে ঠাকুরদার ঘরেই মাস্টার দা সূর্যসেনের অনুসারিরা রাতভর সভা করতেন। বাল্যবেলায় এসব দৃশ্য দেখেই বড় হয়েছেন তিনি। মাস্টার দা তার জন্মের আগেই শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তার পরিবারে ওই বিপ্লবীর চেতনাগত শক্তিটি সক্রিয় ছিল। বাল্যবেলায় ভুত প্রেতের গল্প আর রূপকথা শুনে ঘুমোতে যাননি, তার বদলে শুনেছেন ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’।
এ বছর আগস্টে পঙ্কজ দা পঁচাশি পেরিয়ে যেতেন। আগস্টের ৬ তারিখে তার জন্ম। এবছরই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হলো তার তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সেইসব দিনগুলি’। নিজেকে নিয়ে লেখেননি, লিখেছেন গত সাত দশকের জীবন ও রাজনীতি। বাঙালির সংগ্রামের গল্প। যেসব সংগ্রামের পরতে পরতে গভীরভাবে ছিলেন তিনি। পঙ্কজ ভট্টাচার্য যেভাবে কথা বলতেন, ঠিক সেভাবেই লিখতেন। কথার বাক্য আর লেখার বাক্য একই রকম। দুই জায়গাতেই স্বরের উচ্চতা সমান। আমরা বহু বহুদিন পঙ্কজ দাকে বলেছি আত্মজীবনীতে হাত দেন। নানা ব্যস্ততায় হয়ে ওঠে না। কয়েক বছর আগে হঠাৎ কোনো একটি সাময়িকীতে দেখলাম নিয়মিত সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায় লিখে চলেছেন। কি নিখুঁত বর্ননা। সন তারিখ ব্যক্তি সময় সবই লিখেছেন। জীবনের তথ্য উপাত্তগুলো অসাধারণ গতিতে তুলে ধরতেন তিনি। ভাষার গাঁথুনি অসাধারণ। তার একটি গ্রন্থ আমরা ‘লোকালপ্রেস’ প্রকাশনী থেকে বের করেছিলাম। ‘দুর্মুখের জার্নাল’। পঙ্কজ দা’;র আশ্রয় প্রশ্রয়ে আমরা নিয়মিত সমালোচনাপত্র ‘ক্রিটিক’ প্রকাশ করি। দাদা ছিলেন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। কিন্তু প্রিন্টার্স লাইনে তার নাম যেত না। তিনি নিয়মিত সেখানে ‘দুর্মুখের জার্নাল’ লিখতেন। লেখা পড়ে আমরা বলতাম, দাদার লেখা মানে রবীন্দ্রনাথের লেখা। তার লেখার গভীরে থাকতো সত্যের আকর। যে অচলায়তনে যতটুকু শক্তি দিয়ে আঘাত করতে হবে, পঙ্কজ দা করতেন। তার বয়ানের ভেতর থাকতো রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মিশেল। তার কলমের কাছে ভীত হয়ে যেত অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিক। তার মুখ নিসৃত পংক্তি হয়ে উঠতো সমাজপ্রগতি ও রাজনীতিক শ্লোগান। পঙ্কজ দা রসিকতা করে বলতেন, ৬ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়ে তার জায়গায় আমাকে পাঠিয়েছেন।
অতি সাধারণ ও নির্মোহ চিত্ত পঙ্কজ দা’কে অসাধারণ করে তুলেছিল। এই চিত্ত তিনি লাভ করেছিলেন পরিবার থেকে। বাল্যবেলায় পরিবারই তাকে উদারতা আর দেশের জন্য জীবন নিবেদনের শক্তি দিয়েছিল।
বাল্যবেলায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য বড়দের সঙ্গে যখন পুজোর মেলায় যেতেন তখন মেলা থেকে কিনতেন মাটি দিয়ে বানানো সূর্য সেন এর মূর্তি। সূর্য সেন তখন ঘরে বাইরে মননে মজ্জায় দাগ কাটছে মুক্তিপ্রাণ প্রতিটি মানুষের। একেবারে বাল্যবেলায় হৃদয়ে সূর্যসেনের বিপ্লব গেঁথেই জীবন শুরু করলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। পড়লেন সূর্যসেনের বাল্যবেলার সেই স্কুল নোয়াপাড়া দয়াময়ী স্কুলে। শিক্ষাব্রতী পিতা প্রফুল্লকুমার ভট্টাচার্য আর স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের এক আশ্রয়স্থল মনিকুন্তলা দেবীর সন্তান হিসেবে তার বাল্যবেলার সমস্ত শিক্ষার মধ্যেই ছিল প্রকৃত জীবনবোধ, দেশাত্ববোধ আর মানবিকতা। দৃশ্যত বাহ্যিক ধন সম্পদ ও বিত্তের চর্চা গোটা পরিবারটিতেই ছিল না। ছিল আদর্শের বৈভব আর নৈতিকতার চর্চা। ছিল ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গভীর এক প্রতিবাদী চেতনা। যে চেতনাই যেকোন অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর সাহসে রূপ নেয়। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কার হন ছাত্র রাজনীতির কারণে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিই তার ব্রত হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় গোটা শিক্ষা জীবনই তার কাটে ছাত্র রাজনীতির ভেতর দিয়ে। কখনো কর্মী কখনো নেতা। ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে পঙ্কজ ভট্টাচার্য সমসাময়িক রাজনীতিকদের কাছে অনন্য এক ছাত্রনেতার প্রতীক হয়ে ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন তারুণ্যে ভরা এক বিপ্লবী। সাহস তার ভেতর থেকে কিশোর তরুণের মতো উৎসারিত হতো। তিনি ছিলেন ধীমান অথচ কর্মচঞ্চল, চিন্তাশীল কিন্তু সময়ের সঙ্গে চলা এক দ্রুতগামী মানুষ।
পঙ্কজ দা নিজের জন্য কখনো কিছু চিন্তা করেননি। এই কারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখে যারপরনাই হতাশ হয়েছেন। বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে শক্তি ও প্রত্যাশা, তার থেকে বহুদূর পিছু হটেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অর্জন খোয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আশাবাদ বিমর্ষ হয়ে গেছে।” ঠিক এই জায়গা থেকেই পঙ্কজ দা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রামকে শাণিত রেখেছিলেন। তার সক্রিয় চিন্তা সবসময় মনে করিয়ে দিত, আবার মানুষকে জেগে উঠতে হবে। সম অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
পঙ্কজ দা বেশ ভোজন রসিক ছিলেন। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বিখ্যাত সব গুণী শিল্পীদের মতো তিনি খুব ভালো রাঁধতেও পারতেন। সেগুণবাগিচায় ভোজ নামের একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁ চালু হয়েছিল। পঙ্কজ দা আবিষ্কার করেন ওখানকার রুমালি রুটি, পঞ্চডাল আর সবজি অমৃত স্বাদের। আমাদের মাঝে মাঝেই নিয়ে যেতেন ভোজ-এ। আমরা পঙ্কজ দা’র পাশে বসে শুধু অমৃত স্বাদই গ্রহণ করতাম না। বিভিন্ন খাদ্যের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে গল্প শুনতাম। রেস্তোরাঁর খাদ্যের সঙ্গে পঙ্কজ দা’র কাটা কাটা বাক্যের যে স্বাদ মাধুর্য, তা আমাদের কাছে ছিল একই সূত্রে গাঁথা। পঙ্কজ দা’র ছাড়াও ওই রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখেছি। তেমন স্বাদ পাইনি। পঙ্কজ দা ওই রেস্তোরাঁয় বসে দুধ চায়ের এক অসাধারণ রেসিপি দিয়েছিলেন। আসল ঘ্রাণ রেখে চা বানানোর ক্ষেত্রেও যে অসামান্য কুশলি আছে তা জেনেছিলাম।
আমাদের রামপুরা হাজীপাড়ার বাসায় ভৈরব ঘাটের ১০ কেজি ওজনের রুই মাছ এনেছিলাম। উদ্দেশ্য পঙ্কজ দা নিজেহাতে মাছের মুড়ো রান্না করবেন। পর্বততুল্য এক রাজনীতিক আমাদের বাসার হেশেলে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মাছ রান্নায়। আমরা তার সহযোগী হলাম। রান্না শেষে সুতৃপ্ত রসনায় সম্পন্ন হলো আমাদের ভুরিভোজ।
অন্যায় আর দুঃশ্বাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল পঙ্কজ দা’র সৌন্দর্য। সংগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্যেই ছিল গণমানুষের জয়লাভের বিষয়। রাজধানী ঢাকায় যখন সরকারি নতুন আবাসন তৈরি ও বরাদ্দের অভিযান শুরু হলো, তখন শুরুতেই ছিল একরের পর একর জায়গা অধিগ্রহণের কাজ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ‘জিন্দাপার্ক’’ এর জায়গাটিও অধিগ্রহণের তালিকায় নেয়া হয়। চারদিক যখন সবুজ উচ্ছ্বেদ করে কংক্রিটের কানন তৈরি করা হচ্ছে, তখন জিন্দাপার্কের অসাধারণ সবুজ পরিবেশ আর পরিকল্পিত বিনোদনের আয়োজনকে গণমুখি হিসেবে নিলেন পঙ্কজ দা। এলাকার মানুষকে নিয়ে শুধু আন্দোলনই গড়ে তুললেন না, রীতিমত সরকারি চাপ প্রয়োগকারীদের সামনে আন্দোলনকারীদের নিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়লেন। বললেন, আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে জিন্দাপার্ক দখল করুন। সে যাত্রায় জিন্দাপার্ক রক্ষা পেল। একবার পহেলা বৈশাখে পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রাখী বৌদি (রাখীদাশ পুরকায়স্ত) আমাদের নিয়ে গেলেন জিন্দাপার্কে। সেখানে দিনব্যাপী বহু স্মৃতি তৈরি হলো। পার্ক কর্তৃপক্ষ সারাজীবনের তরে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়ে আছেন।
একবার পহেলা বৈশাখ উদযাপেনের জন্য পঙ্কজ দা আমাদের নিয়ে গেলেন রাঙামাটিতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির নেতা জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) আমন্ত্রণ। পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির ঘরে ঘরে পঙ্কজ দার যে সম্মান ও মর্যাদা তা দেখে রীতিমত অবাক হয়েছি। ঘরে ঘরে বৈসাবি উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা ও বৈশাখের বিশেষ খাবারে (পাজন) অংশ নিয়েছেন পঙ্কজ দা। আমরাও অংশ নিয়েছি তার সঙ্গে। দেখেছি পাহাড়ের মানুষ তার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞ। পঙ্কজ দা সন্তু লারমার বড় ভাই মানবেন্দ্র লারমার বন্ধু। ষাটের দশক থেকে আন্দোলন সংগ্রামে তৃণমূল মানুষের পাশে সমানভাবে থেকেছেন তারা। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর পাহাড়ের প্রতিপক্ষ সশ্রস্ত্রবাহিনীর আক্রমণে নিহত হন মানবেন্দ্র লারমা। তার স্মৃতি নিয়ে সেই থেকে প্রতি বছর রাজধানীতে স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন পঙ্কজ দা। পাহাড়ের যেকোনো নীপিড়িত মানুষের মাঝে সবসময় ছিল তার সক্রিয় উপস্থিতি। তিনি এমন এক জীবনধারা লালন করতেন যে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সাধারণ তৃণমূল মানুষের মাঝে তিনি তাদের নিজস্ব মানুষ হয়ে যেতেন। হয়ে যেতেন নিজস্ব নেতা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র এবং জীবনভর সাহিত্যের পাঠক পঙ্কজ দা বাঙালির নৃতাত্ত্বিক শক্তিগুলো গভীরভাবে ধরতে পারতেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবন বাস্তবতার গভীরে চলে যেতেন। মৃত্যুঅবধি পঙ্কজ দা যে দুয়েকজন ব্যক্তিগত কর্মীর সার্বক্ষণিক সেবা পেয়েছেন তারা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির।
শুধু পাহাড় নয় সারাদেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির সঙ্গে পঙ্কজ দা গড়েছিলেন গভীর সখ্য। তিনি নিজেই নিয়মিত খোঁজ রাখতেন সেসব মানুষের। যেখানেই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি নিগৃহীত হয়েছে, সেখানেই কালবিলম্ব না করে ছুটে গেছেন পঙ্কজ দা। একজন রাজনৈতিক সামাজিক মানুষ হিসেবে যে সাংগঠনিক দায় অনুভব করেছেন, তা পুরা করে এসেছেন। এসবের মধ্যেই জীবনের তৃপ্তি ও আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
চেনামুখগুলো নিয়ে তার ভাবনা ছিল বহুদূর বিস্তৃত। শিল্পীর মতো গভীর আর সম্পূর্ণ ছিল তার ভাবনা। নতুন প্রজন্ম নিয়ে ভাবতেন। ভাবতেন নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশ নিয়ে। ২০১৪ সালে গণ জাগরণ মঞ্চ তাকে দারুণ আশান্বিত করেছিল। একইভাবে স্কুলের ছাত্ররা যখন রাস্তায় নেমে ‘দেশ মেরামত’ এর অভিযান শুরু করেছিল, তার ভেতর অমিত শক্তি আর সম্ভাবনা দেখেছিলেন পঙ্কজ দা। বলেছিলেন, সময় ঠিকই নেতা তৈরি করে নেয়। সময়ই সৃষ্টি করে জাগরণ।
পঙ্কজ দা’র উপস্থিতি ও কাজের চিহ্ন কখনো মুছবে না। তিনি বহু বিপন্ন মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করেছেন। বহু নেতা তৈরি করেছেন। তার বক্তব্য ও চিন্তা খোরাক হয়েছে রাজনৈতিক দর্শনের, খোরাক হয়েছে রাজনৈতিক অর্থনীতির। সেই শক্তির জায়গাটি মানুষ অনুভব করতেই থাকবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)