শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার। এ অধিকার বাস্তবায়নে যথাযথ প্রক্রিয়ায় শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সকল শিশু-কিশোরকে শিক্ষা তথা বিদ্যালয়মূখী করা এবং তাতে উৎসাহিত করা বর্তমান সরকারের এক সূদূরপ্রসারী যুগপৎ এবং চলমান চিন্তাধারা।
মানুষের মৌলিক ৫টি চাহিদার প্রথমটি হলো খাদ্য আর পঞ্চমটি হলো শিক্ষা। শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ ও অটুট স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী বয়সের শিশুদের এ সকল চাহিদা পূরণ ও শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্কুল মিল কার্যক্রম বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা করে যা পরবর্তীতে অনুসৃত হয়ে আসছে। মাঝখানে কিছুদিন এ কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর পূর্বের ধারাবহিকতায় বর্তমান সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যৌথভাবে ২০১১ সাল থেকে শুরু করে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, যা দেশের ১০৪টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করেছে। এ কর্মসূচির আওতায় ৩২.৩১ লক্ষ প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। প্রতি স্কুল দিবসে প্রতিটি শিশুকে উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ ৭৫ গ্রাম বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। সময়ে সময়ে বিস্কুটের স্বাদের বৈচিত্র্য আনয়নপূর্বক বিস্কুটকে উপাদেয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপরে ৩টি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে রান্না-করা খাবার সরবরাহ করা হয়। স্কুল মিল কর্মসূচিকে সর্বজনীন করার বিষয়টি সর্বদাই সরকারের অগ্রাধিকার বিবেচনায় রয়েছে।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণসহ শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১৯ সালে জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ কার্যক্রমে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও শিক্ষা কার্যক্রমে স্থানীয়দের অধিকতর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র সৃষ্টির পাশাপাশি কার্যক্রমটি স্থানীয় অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করায়ও সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। প্রণীত এ নীতির আলোকে স্কুল মিল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০’-এর শিক্ষা-লক্ষ্য অর্জন ও মধ্যম আয়ের দেশের পথে অগ্রযাত্রায় যোগ হতে পারে নতুন মাত্রা। এই কর্মসূচিকে পৃথক প্রকল্প হিসেবে না দেখে জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের মূল পরিকল্পনায় আনা এবং এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য একটি পৃথক নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োজনে আইন প্রণয়নকে সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। বর্তমান সরকার বিদ্যালয়ে কাক্সিক্ষত শিখনফল অর্জন, শতভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি, ছেলে-মেয়ের বৈষম্যসহ শিক্ষায় সকল ধরনের বৈষম্য নিরসন, ঝড়ে পরা রোধ সহ প্রাথমিক শিক্ষার কার্যকারিতা বৃদ্ধি প্রভৃতির জন্য নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এসব কার্যক্রমে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন অংশীজন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এই কর্মসূচির আওতায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ফলে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে, নীরব বিচ্যুতি (silent exclusion) ও ঝরেপড়া (dropout) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শ্রেণিকক্ষ উন্নয়ন, শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতির উন্নয়নসহ শিক্ষায় জনঅংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুল মিল কর্মসূচিকে সর্বজনীন করার মাধ্যমে শিক্ষায় সকল ধরনের বৈষম্য নিরসন, শিক্ষার্থীদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা এবং শিখনফল অর্জন ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখা সম্ভব। টেকসই উন্নয়ন ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। এ জন্য স্কুল মিল কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিশুদের শিখনসক্ষমতা বৃদ্ধি ও পুষ্টিঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সুশীল সমাজ ও আগ্রহী সকল মহলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ নীতি গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সার্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় সরকার পর্যায়ক্রমে দেশের সকল প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থীকে স্কুল মিল কার্যক্রমের আওতায় আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এরইমধ্যে ২০২৩ সালের মধ্যে সারাদেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে’ মিল চালুর লক্ষ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে ‘বিভিন্ন স্থানে যে মিড ডে মিল চালু হয়েছে পাইলট ভিত্তিতে, তাকে কিভাবে সমন্বিতভাবে সারাদেশে ছড়ানো যায় তার জন্য এই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।’ অনুমোদিত এই আইনের খসড়া অনুযায়ী জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ নামে একটি কর্তৃপক্ষ থাকবে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে একটি সেল বা ইউনিট কাজ করবে। কার্যক্রমের পরিধি সম্প্রসারণে প্রয়োজনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পৃথক জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি কর্তৃপক্ষ (ন্যাশনাল স্কুল মিল অথরিটি) গঠন করার প্রস্তাব করা হয় । স্কুল মিল কর্মসূচির কার্যক্রম, ধরন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কতগুলো বিধিবিধান দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালরীর ন্যূনতম ৩০ ভাগ স্কুল মিল থেকে আসা নিশ্চিত করা হবে। যা প্রাথমিক এবং প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৩ থেকে ১২ বছর বয়েসি ছেলে ও মেয়ে শিশুদের জন্য প্রযোজ্য হবে। এই বয়সি স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যূনতম মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট’র ৫০ শতাংশ স্কুল থেকে আসা নিশ্চিত করা হবে। এরই মধ্যে মিড ডে মিলের আওতায় বর্তমানে সরকার তিনটি উপজেলায় রান্না করে খাবার পরিবেশন করছে। ১০৪টি উপজেলায় বিস্কুট খাওয়ানো হচ্ছে। যার মধ্যে ৯৩টি উপজেলায় সরকার অর্থায়ন করছে।
শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী মিড ডে মিল চালু এলাকায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি, ঝরেপ ড়া কমে আসা এবং শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সাফল্যের পরিসংখ্যান দেখা যায়। সারাদেশে মিড ডে মিল চালু হবার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ী থেকে না খেয়ে আসলেও তারা স্কুলে আসার পর আর ক্ষুধার্ত থাকবে না, পুষ্টিহীনতায় ভুগবে না, সকল শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে একই সময়ে একই ধরণের খাদ্য গ্রহণ করবে বিধায় তাদের মধ্যে সাম্যেও পরিবেশও বিরাজমান হবে। এই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারটি বাস্তবায়ন করার ফলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই শিক্ষার্থীরা পুষ্টিহীনতার অভিশাপ থেকে পাবে মুক্তি, বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাথীদের মাঝে থাকবে না বৈষম্য, সাম্যের এ দৃশ্য ভালো লাগার, এ দৃশ্য ভালোবাসার। রূপকল্প ২০৪১ এর স্মার্ট বাংলাদেশে গড়ে তোলার মূল সেনানীরা এগিয়ে যাবো দূর্বার গতিতে। আর তাই বলা যায় থাকবে না কেউ পুষ্টিহীন, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে স্কুলে থাকবে মিড ডে মিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)