বুসানে হাসি-কান্নায় মুগ্ধ দর্শক, প্রতিক্রিয়ায় আপ্লুত ফারুকী
বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ফারুকীর প্রথম ইংরেজি ভাষার ছবি ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’
এশিয়ার সবচেয়ে দাপুটে চলচ্চিত্র উৎসব বলা হয় বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে। ৬ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে উৎসবের ২৬তম আসর। শনিবার (৯ অক্টোবর) এই উৎসবে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হলো দেশের মেধাবী নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম ইংরেজি ভাষার সিনেমা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’।
বাংলাদেশিদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় কোয়ারেন্টাইন জটিলতা বহাল থাকায় উৎসবে যোগ দিতে পারেননি ফারুকী। এজন্য কিছুটা আফসোস আছে! কেননা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ শুধু পরিচালকের প্রথম বিদেশি ভাষার ছবিই নয়, এটি পুরোপুরি নতুন অভিজ্ঞতায় নির্মিত বিরাট ক্যানভাসের ছবি। অথচ এই ছবির প্রথম ‘পাব্লিক শো’তে থাকতে পারেননি!
তবে সশরীরে না থাকলেও ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ প্রদর্শনীর পর থেকে ঠিকই একের পর এক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন ‘টেলিভিশন’ খ্যাত এই পরিচালক। জানালেন, নিজে উপস্থিত না থাকতে পারলেও ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ এর প্রযোজকদের একজন শ্রীহরি সাঠে প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন। তার মাধ্যমেও ছবিটির প্রথম প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা কিছুটা শুনতে পেরেছেন।


চ্যানেল আই অনলাইনকে ফারুকী বলেন, বুসানে আমার প্রডিউসার শ্রীহরি সাঠে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ থেকে আবু শাহেদ ইমন ছিলো- ওদের কাছে শুনলাম যে অডিয়েন্স ছবিটা খুব পছন্দ করেছে। ছবির জার্নির সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। ছবির চরিত্রের সাথে সাথে হাসি, কান্নার ভেতর দিয়ে তারাও ভ্রমণ করছে। এসব শুনে সত্যিই খুব ভালো লাগছে।
বাংলাদেশ থেকে ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’ সিনেমার প্রতিনিধি হিসেবে বুসানে অবস্থান করছেন নির্মাতা আবু শাহেদ ইমন। তিনি এই ছবির প্রযোজক। শনিবার ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এই নির্মাতা এটিকে ‘মাস্টারপিস’ বলেও নিজের মত ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, এই ছবিটি সত্যিকার অর্থেই আন্তর্জাতিক একটি ছবি হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে ছবিটিকে ফারুকীর ‘সেরা ছবি’ বলেও মন্তব্য করেন এই প্রযোজক, নির্মাতা।
এ বছর ফারুকীর ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ সহ মোট তিনটি সিনেমা বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শীত হচ্ছে। বাকি দুটো তরুণ নির্মাতা মোহাম্মদ রাব্বি মৃধার প্রথম সিনেমা ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’ এবং কানে প্রদর্শীত আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। বুসানের মতো বড় আসরে একসঙ্গে দেশের তিন ছবি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম! বিষয়টিকে বাংলাদেশি সিনেমার জন্য মাইলফলক মনে করছেন অনেকে।

এ বিষয়ে ফারুকী বলেন, তিন জন পরিচালকের তিনটি ছবি এবছর বুসানে। এটা বাংলাদেশের সিনেমার জন্য দারুণ বছর বলা যায়। একই সঙ্গে আমি এটাও বলতে চাই, আমাদের পাইপ লাইনে কিন্তু অনেক ইন্টারেস্টিং ফিল্ম মেকার আছে। আমরা তাদের জন্য প্রপার ইকো সিস্টেম তৈরী করতে পারি নাই যদিও এখনও, মানে ফিল্ম পলিসির ক্ষেত্রে। যেমন থিয়েটার চেইন তৈরী করা, ডিস্ট্রিবিউশনে ন্যায্য হিস্যা পাওয়া, প্রডিউসারের সেটা নিশ্চিত করা। এই জিনিসগুলো যদি আমরা প্রপারলি তৈরী করতে পারতাম, পাঁচটা বড় শহরে যদি আমরা মাল্টিপ্লেক্স তৈরী করতে পারতাম, তাহলে আমি মনে করি আরও অনেক ইন্টারেস্টিং ফিল্ম মেকারের দেখা পেতাম।
নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে ‘ডুব’ এর এই নির্মাতা বলেন, ‘পাশাপাশি ওটিটি এখন আমাদের ফিল্মমেকারদের জন্য একটা বড় জায়গা হয়ে উঠছে। তাই আমি মনে করি, সেটাকেও কাজে লাগিয়ে আমাদের ইয়াং ফিল্মমেকারদের ছবির সংখ্যা আরো বাড়বে। ফলে সামনের দিকে আমরা আরো মেজর ওটিটি প্লাটফর্ম বা ফেস্টিভালগুলো আমরা আমাদের ছবি দেখতে পারবো।’
এদিকে ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ ছবির কাহিনী নিয়ে নির্মাতা আগেই জানিয়েছেন, ‘নির্মাতা হিসেবে নিজের ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতিকে সিনেমায় ব্যাখ্যা করেছি! যা মানসিক আঘাত আমার পৃথিবী নিয়ে ভাবনার এবং দেখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমার জন্ম হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল নোয়াখালিতে। এই এলাকার মানুষদের নিয়ে বহু বছর ধরেই ট্রল করা হয়। তাই, খুব কম বয়সেই আমি বুঝে গেছি, এই ট্রলের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে! কোন এলাকা থেকে এসেছি তা নিয়ে মিথ্যা বলা শুরু করলাম। আমার স্কুলের কোনো বন্ধুকে বাড়িতে আনতাম না, তারা যেন আমার বাবা মায়ের আঞ্চলিক ভাষা শুনে আমার এলাকা সম্পর্কে ধারণা করতে না পারে। বড় হতে হতে বুঝতে পেরেছি এটা মনের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে, কীভাবে আমাদের হৃদয়ে একটি শূন্যস্থান তৈরি করে দেয় যখন আমরা নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারি না, নিজেকে গ্রহণ করতে পারিনা, নিজের পরিচয় নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারি না। এই বিষয়টি আমার কাজে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ছোটবেলার এই অস্তিত্বহীনতার ব্যথা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ -এর কেন্দ্রীয় চরিত্র অনুভব করে।’
ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আছেন তাহসান, অস্ট্রেলিয়া থেকে মেগান মিশেল, ভারত থেকে ঈশা চোপড়া, বিক্রম কোচার এবং কিরণ খোজে। ছবিতে সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি সহপ্রযোজক হিসেবেও যুক্ত হয়েছেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’-এ প্রযোজক হিসেবে যুক্ত আছেন ফরিদুর রেজা সাগর, অঞ্জন চৌধুরী, নুসরাত ইমরোজ তিশা, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী ও আমেরিকান প্রযোজক শ্রীহরি সাঠে। কো-প্রডিউসার হিসেবে আছে বঙ্গবিডি।

‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ এর পর চলতি বছরেই ফারুকী ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য নির্মাণ করেছেন ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ নামের একটি ওয়েব সিরিজ। তারকাবহুল এই সিরিজটিও বাংলাদেশ-ভারতে সমানজনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে এই নির্মাতা ব্যস্ত আছেন প্রেমের গল্প নিয়ে।
এ বিষয়ে নির্মাতা জানান, আমি অনেক দিন ধরেই প্রেমের গল্প নিয়ে নির্মাণের কথা ভাবছি। এখন প্রেমের গল্প ‘ডুব’ এর মধ্যেও কিছুটা আছে। কিছুটা অন্য ঢঙে। আবার ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ পুরোটাই আসলে প্রেমের গল্প। কিন্তু আমি প্রেমের গল্প বলতে বোঝাতে চাইছি, যে গল্পগুলো মূলত ডিল করবে মানব মানবীর প্রেম নিয়ে। বিভিন্ন রকমের প্রেম। এরকম গল্পগুলো নিয়ে আমি বহুদিন ধরেই কাজের কথা ভাবছি। এক ধরনের তাড়না পাচ্ছি মনের মধ্যে এখন। সেটা নিয়েই চিন্তা ভাবনা করছি। কীভাবে কাজটি হবে, কী ধরনের কাজ, কোথায় কাজটি দেখা যাবে- এগুলো সামনে জানাবো।