নেটফ্লিক্সের জন্য নির্মিত ‘খুফিয়া’র মাধ্যমে বলিউড সিনেমায় পা রাখলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন ‘ওমকারা’ ও ‘হায়দার’ খ্যাত পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ। সিনেমাটি মুক্তির পর বাঁধনের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স বাংলাদেশের অধিকাংশ দর্শকদের মুগ্ধ করলেও, তীব্র অভিযোগ সিনেমাটিতে বাংলাদেশের উপস্থাপন নিয়ে!
বলিউডের সিনেমায় বাংলাদেশের একজন অভিনয়শিল্পী কাজ করেছেন, স্বভাবতই সিনেমাটি নিয়ে শুধু সিনেমার নিয়মিত দর্শক নয়; দেশের সব শ্রেণির দর্শকদের তুমুল আগ্রহ দেখা গেছে। ৫ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিংয়ের পর ‘খুফিয়া’ দেখার হিড়িক পড়ে! তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সিনেমাটি নিয়ে নেটিজেনদের শত শত মন্তব্যে!
বেশীর ভাগ নেটিজেনরা বলিউডের সিনেমায় বাঁধনের দুর্দান্ত অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন! বিশেষ করে শোবিজ অঙ্গনের তারকাকের স্ট্যাটাসে বাঁধন বন্দনাই দেখা গেছে বেশী। সাধারণ দর্শকরাও বাঁধনের অভিনয় নিয়ে জানিয়েছেন মুগ্ধতা। তবে সিনেমাটি নিয়ে অনেকেই তীর্যক মন্তব্য করেছেন। চলচ্চিত্র অঙ্গন ছাড়াও শিল্পসাহিত্য সংশ্লিষ্ট অনেককেই ‘খুফিয়া’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করতে দেখা গেছে।
টাবুর সাথে বাঁধনের পাল্লা দিয়ে অভিনয় করার বিষয়টি আলাদাভাবে প্রায় বেশীরভাগ নেটিজেনই উল্লেখ করেছেন। তবে সিনেমায় বাংলাদেশকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়েই হচ্ছে সমালোচনা। কেউ সিনেমাটিক দৃষ্টি দিয়ে খুফিয়াকে দেখার চেষ্টা করছেন, তো কেউ আবার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে সিনেমাটির ব্যবচ্ছেদ করছেন।
‘খুফিয়া’ দেখে দেশের জনপ্রিয় নির্মাতা শিহাব শাহীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন,“প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য শেষ পর্যন্ত দেখতে হল ‘খুফিয়া’। উত্তরটা পেয়ে কেমন লাগলো তা বলব না। তবে বাঁধনের অভিনয় ভাল লেগেছে। বাঁধনের সাহস ভাল লেগেছে।”
‘খুফিয়া’ নিয়ে প্রায় বেশীরভাগ নেটিজেনের মন্তব্য এই নির্মাতার মতোই। শিক্ষাবিদ ও লেখক কাবেরী গায়েনের মতামত অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম। সিনেমাটি নিয়ে তার ভাষ্য, ‘খুফিয়া’ দেখলাম। এই থ্রিলার নিয়ে এতো কথা! টাবু বরাবরের মতো চমৎকার। শেষ দৃশ্য সুন্দর। কাহিনী, নির্মাণ কোথাও কোন বিশেষত্ব পেলাম না। আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের কাহিনী দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, বলা ভালো ঘুটা দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া এর আর কী কারণ আমি অন্তত বুঝিনি।
তিনি আরও বলেন, “খুফিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল তথ্যে ঠাসা। গোটা কাহিনী দেখেও কোন রহস্য রোমাঞ্চের আভাস পেলাম না। অনেকেই বাঁধনের অভিনয়ের অনেক প্রশংসা করেছেন। কিন্তু বাঁধনের পর্দা উপস্থিতি এতো কম এবং কাহিনীতে তার করার সুযোগ এতো কম ছিলো যে তার অভিনয় ভালো না মন্দ হয়েছে বুঝিনি। আমি বরং বাঁধনকে বলবো তিনি আমাদের গুরুত্ত্বপূর্ণ অ্যাক্টর তাই পরে কাহিনীতে নিজের চরিত্র দেখে বুঝে যেনো তিনি স্বাক্ষর করেন।”
খুফিয়াতে ঐতিহাসিক তথ্য বিভ্রাটের কথা তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্র সম্পাদক সিমিত রায় অন্তর। তার ভাষ্য,“খুফিয়া সিনেমায় বাংলাদেশের ২০০৪ সালের প্রধানমন্ত্রী দেখানো হয়েছে শেখ হাসিনাকে। আর ভারত ভয় পাচ্ছে সামনের নির্বাচনে জামায়াত সরকার গঠন করবে। অথচ বাস্তবতা হলো, ২০০৪ সালে জামায়াত ক্ষমতায়, বিএনপির সাথে জোট হিসেবে। ২০০৪ সালেই ঘটেছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ভারতীয় জঙ্গী গোষ্ঠী উলফার জন্য চট্টগ্রামে এসেছিল ১০ ট্রাক অস্ত্র। ২০০৫ সালে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলা।”
অসংখ্য দর্শকপ্রিয় সিনেমার এই সম্পাদক আরও লিখেন,“২০০৪ সালে শাহরুখ খানের ‘ম্যায় হু না’ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, তা মিলাতে পেরেছে, অথচ তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন, তা মিলাতে পারেনি? বাংলাদেশকে যখন টানলোই, তখন সঠিক তথ্য দিয়ে টানা উচিত ছিল। নয়ত এখন সিনেমায় দেখানো হলো, তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জঙ্গীবাদের সাথে জড়িত ছিল! তবে সিনেমায় দারুণ অভিনয় করেছেন ওয়ামিকা গাব্বী। এই প্রথম তাকে এত বড় রোলে দেখলাম, আর সে করেছেও দারুণ।”
‘খুফিয়া’র সামগ্রিকতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট মুনমুন শারমিন শামস। তিনি লিখেন,“পুরো সিনেমায় আমার পর্দায় টাবু আর বাঁধনের শক্তিশালী অভিনয় এবং তাদের অ্যাপিয়ারেন্সকে বেস্ট পার্ট মনে হয়েছে। আর সবচেয়ে বাজে লেগেছে চারু নামের চরিত্রটিকে অকারণে পোশাক খুলিয়ে নাচার ব্যাপারটা। এই দৃশ্যায়নটাকে আমার কাছে একেবারে ইন্টেনশনালি দর্শক সুড়সুড়ি তৈরির অংশ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। সিনেমায় নারীর বুদ্ধিমত্তা ও কাজের দক্ষতার যে জায়গাটা ছিল, চারুর এই আজাইরা নাচ সিনেমা মেকারের সেই আরোপিত ফেমিনিস্ট সত্তাকে ছাপিয়ে মগজের গহীনে থাকা শভিনিজমকেই প্রমাণ করেছে। বাঁধনকে এত সাবলীল লেগেছে, ঠিক বরাবর সব সিনেমা ও সিরিজে যেমন লাগে। গুটিতে বাঁধন অনবদ্য ছিল। রেহানা মরিয়ম নূরেও তাই। খুফিয়াতেও মনে হচ্ছিল ও যেন একদম অক্টোপাস চরিত্রটার ভেতরে ঢুকে গেছে। ও নিজেকে একই সাথে স্ট্রাগলিং একটা মেয়ে আবার মুহূর্তে ভয়ানক গ্ল্যামারাস একটা মানুষে পরিণত করতে পারে। এটা ওর অভিনয় প্রতিভার সবচেয়ে বড় চমক।”
বলিউডের প্রখ্যাত নির্মাতা বিশাল ভরদ্বাজ। তার নির্মাণে আছে বেশ কিছু কালজয়ী সিনেমাও। নিজের নামের সুবিচার তিনি কতোটা ‘খুফিয়া’-তে করতে পারলেন, সেই ভাষ্য কিছুটা উঠে এসেছে চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরুর মতামতে।
খুফিয়া দেখে বিধান রিবেরু লিখেছেন, “বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল, সাত খুন মাফ, হায়দার এসব ছবি দেখা। এগুলোর তুলনায় তার নতুন ছবি ‘খুফিয়া’র চিত্রনাট্য ভীষণ দুর্বল ঠেকল। অভিনয়ে টাবু, বাঁধন ও গাব্বি পাল্লা দিয়ে ভালো অভিনয় করেছেন। উল্টোদিকে পুরুষদের মধ্যে আশীষ বিদ্যার্থী ছাড়া সকলে মাঝারি মানের। এবার আসি চিত্রনাট্য প্রসঙ্গে। এই ছবিতে আধ্যাত্মিক বাবার ইলেকট্রিক গিটার নিয়ে নাচানাচি ও গান এবং চারুকে অর্ধনগ্ন করে নাচানো ফেটিশ মনে হয়েছে। তাছাড়া হেনা ওরফে অক্টোপাস কেন দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর উপর ক্ষিপ্ত এবং কেনই বা হঠাৎ ভারতীয় গোয়েন্দা কেএমের প্রেমে পড়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে মেলামেশা শুরু করবে তার কোনো কনভিন্সিং কারণ এতে নেই। যা আছে তা বড্ড দুর্বল।”
এই চলচ্চিত্র সমালোচক আরও লিখেন,“গুপ্তচরবৃত্তি হৃদয়বৃত্তি নয়। ছবির যে থিম: আমেরিকা পাকিস্তানকে তলে তলে যে সহায়তা করছে বাংলাদেশের মাধ্যমে এটা ভারত চায় না। ভূরাজনৈতিক বার্তা এখানে স্পষ্ট। কিন্তু এই স্পাই থ্রিলার কাহিনির সাথে বাবার প্রতি কর্তব্য, মায়ের মমতা ও সমকামীতা মেশাতে গিয়ে মূল স্টোরি স্টাবলিশে একটু তাড়াহুড়ো হয়েছে। মানে সময় কম পেয়েছে। যে কারণে রবির মা কেন অতোটা ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠলো সেটা যেমন ভাসাভাসা রইলো, তেমনি অক্টোপাস কেন মরিয়া হয়ে উঠলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার জন্য কাজ করতে সেটাও ভালো করে প্রতিষ্ঠা পেলো না। যাইহোক এই দুর্বল ছবিতে সবল জায়গাটি আমার মনে হয়েছে টাবু আর বাঁধনের অভিনয়। তারা যখন স্ক্রিন শেয়ার করছেন, আমি বলবো আলাদা রসায়ন তারা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। শুকরিয়া।”
খুফিয়া পরিচালনা: বিশাল ভরদ্বাজ অভিনয়: টাবু, বাঁধন, আলী ফজল, ওয়ামিকা গাব্বি, আশীষ বিদ্যার্থী প্রমুখ। জনরা: অ্যাকশন, ক্রাইম ব্যাপ্তী: ২ঘণ্টা ৩৭ মিনিট মাধ্যম: নেটফ্লিক্স