চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে ৩২ জেলা, ঢাকা-রাজশাহীতে শনাক্ত বেশি

দেশের ৩২টি জেলা এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাস জনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ।

এর মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা বেশি ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে। এ ভাইরাসে  ২০০১ সালে থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৩৩৫ ব্যক্তি সংক্রমিত হয়েছেন এবং ২৩৫ জন মারা গেছেন।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর তথ্য মতে, নিপাহ একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। এ রোগে মৃত্যুহার অনেক বেশী (৪০-৭৫%)। ১৯৯৮-৯৯ সালে নিপাহ ভাইরাস রোগের প্রথম প্রাদুর্ভাব মালোয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ নামক গ্রামে দেখা দেয়। এই গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নামকরণ ।

মূলত ফল আহারী বাদুড়ই নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক, সব বাদুড়ই এই ভাইরাসের বাহক নয়। ফল আহারী বাদুড় নিজে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাস রোগের কোন টিকা এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, সতর্কতা ও সচেতনতাই এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়।

নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে ৩২ জেলা
শুক্রবার রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শেখ দাউদ আদনানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অদ্যাবধি দেশের ৩২টি জেলা নিপাহ ভাইরাস জনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের প্রতি হাসপাতালে জ্বরের উপসর্গ নিয়ে আগত রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য কর্তব্যরত চিকিৎসকদের নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী অনুসরণ করে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হল।

রোগী দেখার সময় আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরিধান করতে হবে। রোগী দেখার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে। জ্বরের উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে আবশ্যিকভাবে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি রাখতে হবে। জ্বরের সাথে সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দিলে রোগী সংশিষ্ট হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হবে। আইসিইউতে থাকাকালীন রোগীর পরিচর্যাকারীগণ শুধুমাত্র গ্লাভস, মাস্ক পরলেই হবে। কেননা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর থেকে বাতাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায় না। যেহেতু আইসিইউতে রেখে এই রোগীর চিকিৎসা করা যায়, এজন্য রেফার্ড করার প্রয়োজন নেই। কোন প্রকার তথ্যের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কল সেন্টারে ১৬২৬৩/৩৩৩ যোগাযোগ করবেন।

রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগে শনাক্তের হার বেশি
আইইডিসিআরের তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী বিভাগের গোদাগাড়ি উপজেলায় এক নারী (৩৫) নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ বছরের ৫ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। একই বিভাগের নওগাঁ জেলায় এক কিশোর (১৩) আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ১১ জানুয়ারি থেকে চিকিৎসাধীন আছেন। নওগাঁ জেলার আরেক নারী গত ৬ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় এক ছেলে শিশু (৭) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ি জেলার  বালাকান্দি উপজেলায় এক কন্যা শিশু (৬) গত ২১ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বালাকান্দি উপজেলার আরেক নারী (২৮) গত ২৪ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ উপজেলায় এক যুবক (১৮) হাসপাতালে ১৯ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার এক পুরুষ (২৯) গত ১৭ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। রাজধানী ঢাকার রমনায় এক নারী গত ১৯ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

২২ বছরে মৃত্যু ২৩৫
আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২২ বছরে (২০০১-২০২৩) ৩৩৫ জন নিপাহ ভাইরাসে শনাক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২৩৫। মৃত্যুর হার প্রায় ৭১ শতাংশ।

২০২৩ সালে এখন পর্যন্ত ১০ জন নিপাহ ভাইরাসে শনাক্ত হয়েছেন ১০ জন, যাদের মধ্যে মারা গেছেন পাঁচ জন। মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। ২০২২ সালে তিনজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান দু’জন। মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। ২০২১ সালে দু’জন শনাক্ত হলেও কেউ মারা যাননি। ২০২০ সালে সাতজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান পাঁচজন। মৃত্যুর হার ৭১ শতাংশ। ২০১৯ সালে আটজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান সাতজন। মৃত্যুর হার ৮৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে চারজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে দু’জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। ২০১৭ সালে তিনজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে দু’জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে কেউ শনাক্ত হননি। ২০১৫ সালে ১৫ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ১১ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৭৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে ৩৭ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ১৬ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৪৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে ৪১ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ২৫ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৮১ শতাংশ। ২০১২ সালে ১৭ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ১২ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৭১ শতাংশ। ২০১১ সালে ৪৩ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ৩৭ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৮৬ শতাংশ।

২০১০ সালে ১৮ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ১৬ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৮৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে চারজন শতাংশ হন, তাদের মধ্যে মারা যান একজন। মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে ১১ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে সাতজন মারা যান। মৃত্যুর হার ৬৪ শতাংশ। ২০০৭ সালে ১৮ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে নয়জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। ২০০৬ সালে কেউ শনাক্ত হননি। ২০০৫ সালে ১২ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান ১১ জন। মৃত্যুর হার ৯২ শতাংশ। ২০০৪ সালে ৬৭ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে ৫০ জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ। ২০০৩ সালে ১২ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান আটজন। মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। ২০০২ সালে কেউ শনাক্ত হননি। ২০০১ সালে ১৩ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে নয়জন মারা যান। মৃত্যুর হার ৬৯ শতাংশ।

যেভাবে নিপাহভাইরাস ছড়ায়
নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত পশুপাখি বিশেষ করে বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেরে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে, মানুষের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পারে। এছাড়া বাদুরে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও রোগ ছড়াতে পারে।

রোগের লক্ষণ
নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এছাড়া লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ও পেশীতে ব্যথা, খিচুনি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেট ব্যথা, বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ রোগে মস্তিষ্কে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, ঘুমঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

চিকিৎসা ও করণীয়
নিপাহর পরীক্ষা এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। এখন পর্যন্ত এ রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই রোগীকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, প্রয়োজনে আইসিইউও লাগতে পারে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিত্সা দিতে হয়, প্রয়োজনে এন্টিভাইরাল ব্যবহার করা যায়। আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল যেমন-আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে।আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে এবং রোগীর পরিচর্যা করার পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।