জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন সেনাপ্রধান, তখন বাংলাদেশে সরকারী ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। সরকার প্রধান ছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। সেই সময়কালে দেশে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল।
সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার ইত্যাদি দেশের মানুষকে শঙ্কিত ও সংক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। দেশ পরিচালনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এসব বিষয় সামাল দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেশার দিয়ে, রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে সামরিক আইন জারি করাতে বাধ্য করে এবং দেশের শাসনভার সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজের কাছে নিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করা হয় বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে।
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। প্রথমে ১৯৮৩ সালের ১৭ মার্চ রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর ‘জনদল’ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়। পরবর্তীতে কৌশলে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী জনদল থেকে সরে দাঁড়ান এবং জনদল জনপ্রিয়তা হারায়। ১৯৮৫ সালের ১৩ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ে আবার জেনারেল এরশাদের উদ্যোগে ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক মোর্চা গঠিত হয়। এই মোর্চায় বিএনপি, জনদল, মুসলিম লীগ, গণতান্ত্রিক পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি এবং কিছু নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে ১৩ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে রাজনৈতিক ফ্রন্ট হয়।
১৯৮৫ সালের ১ অক্টোবর জেনারেল এরশাদ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা সীমিত আকারে তুলে নিয়ে মাত্র ছয় মাসের মাথায় ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ বিলুপ্ত ঘটান। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় ‘জাতীয় পার্টি’। আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেই হন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
১৯৮৬ সালের মার্চ থেকে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৬ সালের ৭ মে যথাযতভাবে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে একচেটিয়া করেন, যেখানে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩টি আসন আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পায় ৭৬টি আসন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ সকল দল কারচুপির অভিযোগ করেন। যার দরুণ দেশি-বিদেশিদের কাছে এরশাদ সরকারের গ্রহণ-যোগ্যতা কমতে থাকে এবং ১৯৮৭ সালে সারা দেশে প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
আন্দোলনের ফলে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন। পুনরায় ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অন্য কোনো দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে জেনারেল এরশাদ এবং জাতীয় পার্টিকে ২৫১ টি আসনই বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়।
১৯৮৯ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তুমুলভাবে যার কারণে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কিন্তু জরুরি অবস্থাও তাকে রক্ষা করতে পারেনি গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৫ আসনে জয়লাভ করে এর ভিতরে স্বৈরাচারী এরশাদ জেলখানায় থেকেও একাই ৫টি আসনে জয় লাভ করেন। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে দলটির শক্ত অবস্থান ছিল। পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করেছি যে দিন দিন জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
মহাজোটের অংশ হিসেবে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল জাতীয় পার্টি তার মধ্যে ২৯টিতে বিজয় লাভ করে। যেসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল এমন ২০ আসনের একটিতেও জাতীয় পার্টি জয় লাভ করতে পারেনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৩টি আসনে জিতেছিল এবং এসব আসনে আওয়ামী লীগ কোন প্রার্থী দেয়নি। আর সারা দেশে ৪৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ১টিতে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আরও যে ১৪৫টি আসনে দু’দলের মধ্যে নির্বাচন হয় তার একটিতেও জাতীয় পার্টি নির্বাচিত হতে পারেনি এবং তাদের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে তবে শেষ পর্যন্ত কিছু আসন ১৪ দলীয় জোটের অন্য দলকে দিবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। আর জাতীয় পার্টি ২৮৭টি আসনে মনোনয়ন দাখিল করেছেন।
জাতীয় পার্টি আলাদা নির্বাচন করলেও দলের সিনিয়র নেতারা যাতে নির্বাচনে জয় লাভ করতে পারে তার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছেন। তবে প্রকাশ্যে আওয়ামী বিরোধিতা যাই বলুন মূলত তারা ৩০টির বেশি আসনে যাতে বিজয় লাভের সুযোগ পাই তার জন্য সরকারের সাথে গোপন সমঝোতার চেষ্টা করছে।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি আসলে একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা ছাড়া তারা নির্বাচন করলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বেন।
১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি ৭% ভোট পেয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইন্তেকালের পর জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব সংকট, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অবিশ্বাস তাদের দলের প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, জনমত জরিপ থেকে আমরা দেখতে পারি জাপার ভোট ৩.৭% নেমেছে। আর তারা যদি নির্বাচনে না আসেন তবে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হবে কিনা ভাবার আগে জাপা ধ্বংসের দিকে যাবে তা প্রায় নিশ্চিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)