গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল থেকে নৈতিক আপত্তি, রাজনৈতিক কারণ বা মিয়ানমারের জান্তা সরকার বিরোধী বিদ্রোহীদের দ্বারা অভিভূত হয়ে পদত্যাগ করছেন হাজার হাজার মিয়ানমার সেনা সদস্য। এমনকি জেনারেলরাও পদত্যাগ করছেন অথবা বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদের প্রশ্ন সরকারের হয়ে ‘কেন নিজেদেরকেই হত্যা করব?’
সংবাদ মাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ান বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দ্যা গার্ডিয়ানকে নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা কয়েকজন সেনা সদস্য,
হতেত মিয়াতের দুঃখ
হতেত মিয়াত নামক দেশটির দলত্যাগকারী সাবেক সেনা অধিনায়ক জানান, মিয়ানমারে এর আগে এমনটা কখনো ঘটেনি যে বিদ্রোহীরা যুদ্ধবিমান নামিয়েছে বা ট্যাঙ্কগুলো দখল করেছে। আমি দুঃখিত। (সেনা সদস্যদের দ্বারা) আমার বাবা-মায়ের বয়সী লোকদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি বিনা কারণে ধ্বংস করা হচ্ছে। আমি এটা দেখেছি, প্রত্যক্ষ করেছি।
তার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, নৈতিক আপত্তির কারণেই দলত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মিয়াত।
দেশ ছেড়েছিলেন ওউনা কিয়াও
গত বছর এক বৃষ্টির রাতে মিয়ানমারের একটি সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে চলে যান সেনা সদস্য ওউনা কিয়াও। সঙ্গে ছিলেন তার মতো আরও কয়েকজন। কারণ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের এমন একটি জায়গায় পাঠানোর কথা ছিল, যেখানে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে।
এই ঘটনার পরের কয়েক মাসে জান্তা বাহিনীর আরও হাজার হাজার সেনা বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এমন পদক্ষেপের জন্য কমপক্ষে ৭ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তবে ওউনা কিয়াওয়ের ভাষ্য, আমার বিশ্বাস, চলে না গেলে আমি সেখানেই মারা যেতাম।
কিয়াওয়ের মন্তব্য থেকে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সক্ষমতার ওপর যথেষ্ট সন্দেহে ছিলেন তিনি। আবার বিদ্রোহীদের কাছে হেরে গিয়ে প্রাণ হারানোর ভয়ও ছিলো তার।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন থান্ট জিন
গত বছর আগস্টের শেষের দিকে দেশত্যাগ করার পর সাবেক সেনা সদস্য থান্ট জিন বলেন, সাগাইং অঞ্চলে সংক্ষিপ্তভাবে মোতায়েন থাকাকালীন তিনি বেসামরিকদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাকে শহুরে এলাকায় টহল দেওয়ার জন্য আনা হয়। তখন তিনি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দ্বারা পাঁচজন বেসামরিকে হত্যা করতে দেখেছেন।
তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তার অভিযোগ; বেসামরিকরা বিদ্রোহী সদস্য। অথচ তাদের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না, কোন গোলাবারুদ ছিল না। মৃত্যুর আগে তাদেরকে নিজেদের কবর খুঁড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। পরে তাদের হাত বেঁধে গুলি করা হয়। ঘটনাটি ২০২২ সালের শেষের দিকের। নিহতদের মধ্যে দুইজন নারী ও তিনজন পুরুষ ছিলেন।
তার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বিচারবহির্ভূত হিসেবে বিবেচনা করেই দল ছেড়েছেন থান্ট জিন।
ইয়ে মিও হেইনের বিশ্লেষণ
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক ইয়ে মিও হেইন বলেন, চলতি মাসের শুরুর দিকে চীন সীমান্তের কাছে লুয়াক্কাই নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর জান্তাবিরোধী যোদ্ধারা দখলে নেওয়ার পর, সামরিক বাহিনীর ৬ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ ২ হাজার ৩৮৯ সেনা সদস্য বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। পুরো এক ব্যাটালিয়ন সেনার এমন আত্মসমর্পণ এবং সবশেষ গোটা আঞ্চলিক অপারেশন কমান্ডের আত্মসমর্পণ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি ঘটনা।
হেইনের হিসেবে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর কমপক্ষে ১০ হাজার সদস্য দল ত্যাগ করেছেন। গত বছর অক্টোবর থেকে শুধু মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলেই বিদ্রোহীদের হাতে জান্তা বাহিনীর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়, জব্দ করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্রধান কিছু শহরও দখলে নিয়ে নেয় বিদ্রোহীরা। যা দেশটির সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ করে।