নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ৮ গোলের রোমাঞ্চের পর টাইব্রেকারে গড়িয়েছিল আবাহনী-মোহামেডানের ফাইনাল মহারণ। শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তটি আসার আগে বদলি গোলরক্ষক হিসেবে নামেন আহসান হাবিব বিপু। মাঠে নামার ছয় মিনিট পর হজম করেন গোল। তখন ৪-৪ স্কোরলাইন। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে কলিন্দ্রেসের হেড ঠেকান বিপু। তাতে ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়। সেখানে প্রতিপক্ষের দুটি শট প্রতিহত করে হয়ে যান মোহামেডানের শিরোপা জয়ের আরেক নায়ক।
মোহামেডানের হয়ে একাই ৪ গোল করে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে মূল নায়ক মালির ফরোয়ার্ড সোলেমান দিয়াবাতে। তবে একটি সুন্দর গল্পের চিত্রনাট্যে পার্শ্ব নায়কের চরিত্রও হয়ে ওঠে মহা গুরুত্বপূর্ণ। সাদাকালোদের সত্যিকারের পার্শ্ব নায়ক তাই বিপুকেই বলা যায়। ফাইনালের পর বুধবার ক্লাব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ফাইনালের আগেরদিন আমরা পেনাল্টি শ্যুটআউট নিয়ে কাজ করেছিলাম। মৌখিকভাবে আমাদের অনেককিছু বলা হয়েছে।’
নায়কদের জীবনেও আনন্দের সঙ্গে থাকে অসীম বেদনা। বৈবাহিক জীবনে ১১ মাসের কন্যাসন্তানের জনক বিপুর জীবনে আছে ভুলতে না পারার মতো এক ট্র্যাজেডি। ২০২০ সালে পুত্র সন্তানের জনক হয়েছিলেন। জন্মের চার ঘণ্টা পরই যার মৃত্যু হয়। সন্তান হারানোর বেদনা মনে চাপা রেখেই বিপু বললেন, ‘কষ্ট নাই। সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। দিন শেষে(পরকালে) হয়তো দেখা হবে।’
২০১২-১৩ মৌসুম থেকে টানা তিন বছর মোহামেডানে খেলেছিলেন দিপু। দলটির হয়ে সুপার কাপ ও স্বাধীনতা কাপের ট্রফি জয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরপরের তিন মৌসুম ভিন্ন তিন দলে খেলেন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে আবারও সাদাকালোদের ডেরায় ফিরে আসেন। ফুটবল খেলতে এসে পড়েছেন একের পর এক চোটে, হাতও ভেঙেছে। তবুও হাসিমুখে বললেন, ‘আমার কোনো কষ্ট নেই। উপরওয়ালা বাঁচিয়ে রেখেছেন, সুস্থ রেখেছেন।’
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ছেলে বিপুর শৈশব বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কেটেছে। সেখানে কলোনিতে সবার সঙ্গে ফুটবলে হাতেখড়ি। তার মামা ছিলেন ফুটবলার, এখন ব্যবসায়ী। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আন্তঃবিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় খেলেছেন।
কুমিল্লায় ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে গত মঙ্গলবারের ফাইনালে আবাহনীর হয়ে প্রথম শট নেয়া রাফায়েল আগুয়েস্তোর প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দেন বিপু। পরে বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দানিয়েল কলিন্দ্রেসের শট তিনি ঠেকালে মোহামেডান ডাগআউট উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। স্কোরলাইন থাকে ৩-২। পঞ্চম ও শেষ শটে কামরুল ইসলামের কিক জালে ঢোকামাত্রই মোহামেডানের নবজাগরণের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। দশ বছর পর ঘরোয়া ফুটবলে কোনো শিরোপা জেতে মতিঝিলপাড়ার দলটি।
ম্যাচের আগে বিপুকে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ম্যাচ অমীমাংসিতভাবে শেষ হওয়ার পর টাইব্রেকারে গড়ালে তাকে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত থাকতে। যদিও আগেভাগেই নামতে হয়। ১১২তম মিনিটে রয়েলের শট সুজন অতিমানবীয় সেভ করে মোহামেডানকে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন। লাফিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় হাতে ব্যথা পেয়ে অনেকক্ষণ কাতরাতে থাকেন শুরুর একাদশে থাকা এ গোলরক্ষক। মাঠে নেমে ফিজিও তার হাতে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দেন। সুজন কান্নায় ভেঙে পড়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। তখন বদলি নামেন বিপু।
টাইব্রেকারের সময় কেমন মানসিক অবস্থা ছিল? এমন প্রশ্নে মোহামেডান গোলরক্ষকের সরল উত্তর, ‘আমার মাথায় এটাই কাজ করেছে দলের জন্য কিছু করা লাগবে। রাফায়েল আগুয়েস্তো সবসময় বাঁ-দিকে স্পট কিক মারে। কালকে(পরশু) ডানদিকে মেরেছে। আমি শট নেয়ার আগে অপেক্ষা করছিলাম। এরপর (ঠেকানো) হয়ে গেল।’
কলিন্দ্রেসের শট প্রতিহত করা নিয়ে বিপুর ভাষ্য, ‘অনুমান করতে পেরেছিলাম সে ডানদিকে মারবে। সময় নিচ্ছিল, আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রায় ২৭ সেকেন্ড সময় নেয়ার পর সে কিক মেরেছে।’