একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর সাংবাদিকদের হাতে একটি বিবৃতিও তুলে দেওয়া হয়। পরদিন তা সকল জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পাশাপাশি ওই বিবৃতিটিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবে ভাষণটি সবকিছু ছাপিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিবৃতিটি পরবর্তীতে আর তেমন আলোচনায় আসেনি। তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক দলিল ওই বিবৃতি।
ড. কামাল হোসেনের ‘বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ এবং সম্প্রতি প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘একাত্তরের মুজিব’ গ্রন্থ সূত্রে দেখা যায় একাত্তরের ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সভায় পরদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও বিবৃতিটির বিষয়ে আলোচনা হয়। সকলেই একমত হন যে, সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সামরিক বাহিনী হামলা করার অজুহাত পেয়ে যাবে, একইসঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষে যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, তাকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই কিছু দাবিসহ দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করে কামাল হোসনকে একটি বিবৃতির খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী, বিবৃতিটি তাজউদ্দীন আহমদের কাছে রাখা হয় যাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে তাতে কোনো সংশোধন বা পরিবর্তনের দরকার হলে তিনি সেটা করে গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তবে ভাষণের পর বিবৃতিটি আর পরিবর্তনের দরকার হয়নি, ভাষণের পরপরিই বিবৃতির কপি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়।
পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ অন্য সকল পত্রিকার মতোও দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ জনসভার সংবাদ এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ‘প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের জবাবে শেখ মুজিব’ শিরোনামে বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়। ‘২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গত শনিবার যে বেতার ভাষণ দেন, তাহার জবাবে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (রবিবার) এক লিখিত বিবৃতি দেন.’ উল্লেখ করে ইত্তেফাক পুরো বিবৃতিটি প্রকাশ করে।
ইয়াহিয়ার `ক্ষমতার ন্যূনতম প্রয়োগ’ বনাম `পর্যাপ্ত ক্ষমতার প্রয়োগ’
৭ মার্চ, ১৯৭১ শেখ মুজিবুর রহমানের ওই বিবৃতিতে বলা হয় (চলিত ভাষায়): ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ (শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র) যারা জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার স্বেচ্ছাচারমূলক ও অযাচিত কাজের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে গিয়েই তাঁরা শহীদ হয়েছেন। এই শহীদদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত বলে চিত্রিত করা সত্যের অপলাপমাত্র। সত্যিকারের ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য যারা দায়ী, বস্তুতপক্ষে তারাই হচ্ছে আসল দুষ্কৃতকারী। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ অবস্থার অবতারণা করা হয়েছে, তা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসার একটু সময় করতেও সক্ষম হননি। প্রেসিডেন্ট যাকে ‘ক্ষমতার ন্যূনতম প্রয়োগ‘ বলে অভিহিত করেছেন, তার ফলে যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হয়ে থাকে, তাহলে কি আমাদের এটাই বুঝতে হবে যে তিনি যাকে ‘পর্যাপ্ত ক্ষমতার প্রয়োগ’ বলবেন, তার লক্ষ্য হবে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া? বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার এই নগ্ন হুমকির আমি নিন্দা করছি । জাতি অনেক অর্থ ব্যয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেছে বিদেশি হামলা প্রতিহত করার জন্য, বেসামরিক নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নয়। অপর অঞ্চলের উর্দি পরা সৈনিকেরা যে বাড়াবাড়ি করছে, তারা দখলদার বাহিনীর মতো যে ভূমিকা পালন করছে, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের আজ রক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন ।
অধিবেশন স্থগিত প্রসঙ্গে
বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন: বলা হয়েছে যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখাকে ‘ভুল বোঝা হয়েছে’। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করতে চাই, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছুসংখ্যক সদস্য এবং একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ঘোষিত অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যালঘু দলের একক খেয়ালের প্রতি সাড়া দিয়েই কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়নি?
আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিলাম। অপর দিকে উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপটি চেয়েছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন হোক। এই সংখ্যালঘু গ্রুপটির মতের কাছেই নতিস্বীকার করা হয়েছে এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও সেই সংখ্যালঘু গ্রুপটি পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আপত্তি উত্থাপন করেছে। প্রথম, এই সংখ্যালঘু গ্রুপ একটি অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য উত্থাপন করে বলেছে যে ঢাকা এলে এর সদস্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং তারা ‘ডাবল জিম্মি’ হয়ে যাবে। এরপর এই দল থেকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে তারা যেসব শর্ত আরোপ করবে, তা মেনে নিলেই শুধু তারা পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে। এরপর আরেক পর্যায়ে এই সংখ্যালঘু গ্রুপের সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। সবচেয়ে যা বিস্ময়কর, তা হলো এই যে উক্ত গ্রুপের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনগত কাঠামো আদেশে আনা হলো একটি সংশোধনী। এতে বলা হয়, পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই সদস্যরা ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করতে পারবেন। কিন্তু এরপর উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিল পদত্যাগ না করার। এই দলের এই এলোপাতাড়ি ইচ্ছা-অনিচ্ছা চরমে পৌঁছাল ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এই দল থেকে ঘোষণা করা হলো যে এই দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া যদি পরিষদের অধিবেশন বসে, তাহলে এই দল গণ- আন্দোলন শুরু করবে। যারা যোগদান করবে, তাদের ওপর জনগণ পূর্ণ প্রতিশোধ নেবে এবং জনগণ যদি প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই দলটিই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই দলটি থেকে আরও হুমকি দেওয়া হয় যে এই দলের কোনো সদস্য যদি পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেন, তাহলে দলীয় কর্মীরাই তাঁদের নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। এই সময়ের মধ্যে আমাদের পার্লামেন্টারি পার্টি ঢাকায় সমবেত হয় এবং পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও পরিষদ সদস্যরা ঢাকা আসতে শুরু করেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারও ঢাকা এসে পৌছান এবং ২ মার্চ পরিষদের মহিলা সদস্য নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্টের নিজেরও পয়লা মার্চ ঢাকা আসার সম্ভাবনা ছিল।
‘রাজনৈতিক বিরোধ’ অচিরেই ‘সামরিক বিরোধে’ রূপ নিচ্ছে
সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিবৃতিতে বলেন: আওয়ামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের নিজেদের অবস্থাও আমরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিদ্ধৃত করেছিলাম ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রদত্ত আমাদের বিবৃতিতে। এতে আমরা পাকিস্তানের প্রত্যেক অংশ থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিটি সদস্যকে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এই ঐতিহাসিক কাজে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা এই পর্যন্তও বলেছিলাম, কোনো সদস্য ন্যায় ও যুক্তিসংগত কিছু পরিষদে উত্থাপন করলে আমরা তা মেনে নেব। কিন্তু সে প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয় এবং তা করা হয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবেই।
পয়লা মার্চ এক বেতার বিবৃতিতে আকস্মিক ও অহেতুকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য অজুহাত দেখানো হয়, সমঝোতা সৃষ্টির জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এ কথাও বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলছে। বাংলাদেশের মানুষ কি এর থেকে মনে করতে পারে না যে একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নির্দেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে? তারা কি যুক্তিসংগতভাবেই ভাবতে পারে না যে একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যাহত করা এবং সংখ্যাগুরু জনসাধারণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কতিপয় শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে? দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে এসব সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। এতে প্রমাণিত হয়, ‘রাজনৈতিক বিরোধ’ অচিরেই ‘সামরিক বিরোধে’ রূপ নিচ্ছে, যদি না সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর নির্দেশের কাছে মাথা নত করে।
কার্যত, ২৪ ফেব্রুয়ারির বিবৃতিতে আমরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, যখনই আমাদের দেশে জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গেছে, তখনই জঘন্য চক্রান্তকারীরা তাতে হস্তক্ষেপ করেছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ গোটাকয় ব্যক্তি গণতন্ত্রকে বানচাল করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বঞ্চনা করেছে। ১৯৫৩ সালে ক্ষমতাসীন পাঞ্জাবি জোটের চক্রান্তে বাঙালি প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। একই চক্র ১৯৫৪ সালে বাংলার নির্বাচিত সরকার এবং খোদ গণপরিষদকেই ভেঙে দেয়। ১৯৫৯ সালের গোড়ার দিকে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল পাঞ্জাবের কায়েমি স্বার্থ সেখানেও আবার আঘাত হানে এবং ক্ষমতা জবরদখল করে নেয়। কিন্তু তাদের এ কথা জেনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাগ্রত জনসাধারণ এবং পশ্চিমাঞ্চলের নির্যাতিত জনতা সম্ভাব্য সব উপায়ে তাদের এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করবেই।
সত্যের খাতিরে আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই, গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হোক—এ ধরনের কোনো ধারণাই আমি দিই নাই। আমি প্রেসিডেন্টকে কেবল এই কথাই জানিয়েছিলাম, বাংলাদেশে কী মারাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা দেখা এবং যথেচ্ছভাবে নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তাঁর ঢাকা আসা উচিত। প্রেসিডেন্ট প্রস্তাবিত পূর্ববর্তী বৈঠকের ব্যাপারে ঘটনা হচ্ছে এই যে আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই কার্যনির্বাহী কমিটি ও পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তখন আমাদের পক্ষে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়া সম্ভব ছিল না। অধিকন্তু আমরা এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলাম যে শাসনতান্ত্রিক সমস্যাদি গোপন আলোচনার বদলে জাতীয় পরিষদ ও তার কমিটিসমূহের মাঝেই সমাধান করা উচিত এবং একবার জাতীয় পরিষদ গঠিত হওয়ার পর গোলটেবিল কিংবা গোপন বৈঠকের কোনো যুক্তিই নাই।
আওয়ামী লীগ কোনোভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে—এ অভিযোগের জবাবেই আমি এসব কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম। এ ধরনের বাধা সৃষ্টি থেকে যাদের ফায়দা হতে পারে, সংখ্যাগুরু দল তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। দেশের জনসাধারণ এবং কার্যত সারা বিশ্বের কাছেই আজ এ কথা পরিষ্কার যে পশ্চিমাঞ্চলের একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নিজে এই সংখ্যালঘু চক্রটির নির্দেশে নতিস্বীকার করাকেই তাঁর নৈতিক কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছেন। একটি সংখ্যালঘু চক্র যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বানচাল করার জন্য কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত হয়, তবে গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা কায়েম কিংবা জনসাধারণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত যদি গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হয়, তবে তার দায়িত্ব এই সংখ্যালঘু চক্র এবং তার সঙ্গে চক্রান্তকারীদেরই বইতে হবে।
এসব মহলই কি সেই ‘গুটিকয় লোক’ নয়, যারা একত্রে বসবাসের ভিত্তি উদ্ভাবনের জন্য জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টার ওপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে? প্রতিটি সুস্থমনা ব্যক্তিই আজ যে প্রশ্নটি উত্থাপন করবেন, তা হচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বত্র নিরস্ত্র জনতাকে গুলি করে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের ‘সংহতি, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করছে, না অন্য কিছু? এ ভূমিকা নিয়ে তারা কি কার্যত বিচ্ছিন্নতার প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করছে না? নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এখন দেশে ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস হচ্ছেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। কোনো ব্যক্তিবিশেষই নিজেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে দাবি করতে পারেন না ।
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এটা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আমরা সমগ্র দেশের জন্যও ক্ষমতার বৈধ উৎস। গত সাত দিনের ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদেরকে বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলি মেনে চলেছে।
প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদস্থ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। কাজেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কারও হস্তক্ষেপ না করা বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে ।
এরপর আমাদের আসতে হয় আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথায়। আমরা বহুবার এ অধিবেশন আহ্বানের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছি। কিন্তু আজ এক অস্বাভাবিক এবং মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণকে সামরিক শক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার নীতির অনুসরণে প্রকৃতপক্ষে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও বিশ্বের সর্বত্র সুবিবেচক জনগণসহ সব দিক থেকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে বলে আওয়াজ তোলা হচ্ছে ।
জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ভীতিপ্রদ পরিবেশে কাজ করবেন, এটা আশা করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আমদানিসহ এই মোকাবিলাজনিত অবস্থা বজায় থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই নির্যাতনের পরিবেশ অব্যাহত থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বেসামরিক জনতার ওপর প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর আসতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা বন্দুকের মুখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয় বিবেচনা করবেন, এটা আশা করা যায় না৷
বিবৃতিতে জানানো দাবি
বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন: যদি প্রেসিডেন্ট আন্তরিকভাবে কামনা করেন যে জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, তাহলে অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে :
ক. অবিলম্বে সকল সৈন্যকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে ।
খ. বেসামরিক জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, যাতে এখন থেকে একটা বুলেটও ছোড়া না হয় ।
গ. সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং দেশের পশ্চিম অংশ থেকে বিপুলসংখ্যক সৈন্য আমদানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
ঘ. বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন শাখায় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চলবে না এবং সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণজনিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে।
ঙ. আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ কেবল পুলিশ ও বাঙালি ইপিআর বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। যখনই প্রয়োজন হবে, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকেরা তাদের উক্ত কাজে সহায়তা করবেন।
চ. অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে ।
ছ. অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
যদি সামরিক মোকাবিলা চলতে থাকে এবং আমাদের নিরস্ত্র জনগণের ওপর বুলেট নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে সন্দেহের কোনো অবকাশ না রেখে আমি বলতে চাই যে সে অবস্থায় কোনো জাতীয় পরিষদই কাজ করতে পারবে না।
জনগণ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হওয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছেন
বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবেই বলেন: আমাদের জনগণ ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা তাঁদেরকে আর উপনিবেশ অথবা বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবেন না। তাঁরা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হওয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছেন। আমাদের অর্থনীতিকে অবশ্যই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতি জনগণকে অনাহার, রোগ ও বেকারত্ব থেকে বাঁচাতে হবে। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ লোকের পুনর্বাসনের কাজ এখনো বাকি রয়েছে। যদি শাসকগোষ্ঠী এ সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে মুক্তির জন্য দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাতে জনগণও প্রস্তুত। যে মুক্তির জন্য অনেক শহীদের রক্ত ঝরেছে এবং যার জন্য বহু লোক চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, জনগণের মুক্তির সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহীদদের রক্ত কখনো বৃথা যাবে না।
আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনগণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে বুলেটের মোকাবিলা করেছেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বাঙালি ও তথাকথিত অবাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দালাল, উসকানিদাতা ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য আমি আমাদের জনগণ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আবারও বলছি যে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি লোকই বাঙালি এবং তার শারীরিক নিরাপত্তা, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করতে হবে। আমাদের সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হচ্ছে অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জিত না হয়, আমাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
কর্মসূচি
বিবৃতিতে তিনি জানান: আগামী এক সপ্তাহের কর্মসূচি :
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে :
১. খাজনা-ট্যাক্স বর্জন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
২. সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোনো কোনো অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে। ৩. রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয়, তাহলে রেলওয়ে শ্রমিক ও বন্দর শ্রমিকেরা সহযোগিতা করবেন না।
৪. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে খবর গোপন করতে পারবে না, অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত বাঙালিরা সহযোগিতা করবেন না।
৫. কেবল স্থানীয় এবং আন্তজেলা ট্রাঙ্ক টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে।
৬. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৭. ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না।
৮. প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে।
৯. অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থাবিশেষে যেকোনো সময় উপরোক্ত ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা হতে পারে।
১০. প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।