কবি ও লেখক মনজুর রশীদ ৯০-এর গণঅভুত্থানের মিছিলের এক সাহসী মুখ। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন দ্রোহ আর বিদ্রোহ বুকে নিয়ে তিনি রাজপথে ছিলেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। শুধু মিছিল নয়, নাট্যমঞ্চেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। ছিলেন পথনাটকে, লেখালেখি এবং কবিতায়। মোদ্দা কথা, সাংস্কৃতিক লড়াই-এর মাঠে তিনি ছিলেন এক পরিচিত মুখ।
কবিতায়, আবৃত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, হল অডিটোরিয়াম, শিল্পকলা একাডেমি মুখরিত করেছেন তিনি বহুবার। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন কবিতাকেই। হৃদয় থেকে তাই কবিতাকে সরিয়ে দেননি। নিরবধি কবিতাকেই ভালোবেসে গেছেন। অব্যক্ত কথাগুলো বলেছেন কবিতায় শব্দ সাজিয়ে।
এবারের একুশের বই মেলাতে কবি ও লেখক মনজুর রশীদের ‘অনুভূতির উঠান জুড়ে’ এবং ‘দৃশ্যমান জনস্রোতে অদৃশ্য দৃশ্যমানতা’ শিরোনামে দুটি কবিতার বই এসেছে। দুটি বইই অসংখ্য কবিতায় ঠাসা। কবিতাগুলো নিঃসন্দেহে যাপিত জীবনের এক অনন্য চিত্র। প্রেম-বিরহ, দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রকৃতি-পরিবেশ সবকিছুই তিনি শব্দমালায় তুলে ধরেছেন। শত সহস্র শব্দের বিনুনিতে আর কথামালায় সমাজের ন্যায়-অন্যায়, বৈষম্য, গণতন্ত্র-অধিকার সবকিছুই তিনি বলতে চেয়েছেন নির্মোহভাবে।
নতুন কবিতার বই ‘অনুভূতির উঠান জুড়ে’তে তিনি উচ্চারণ করেছেন-
‘জীবন মানে ধরার বুকে হঠাৎ আগমন
আদর যত্ন ভালবাসায় পুলকিত মন।
জীবন মানে ধাপে ধাপে হরেকরকম খেলা
কেউ জানে না সুখে দুখে কাটবে কোন বেলা।
জীবন মানে সুরের সাথে বেসুরো সব গান
হাসির ভেতর লুকিয়ে থাকা অনেক অভিমান।’
কবি মনজুর রশীদ ‘জীবন মানে’ কবিতায় জীবনের কথাগুলো ঠিক এভাবেই বলেছেন। মনজুর এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে নিজেকে নিবেদন করেছেন অনেক অনেকদিন। উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন অনেক অনেক দিন। শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরেও এ পেশাতে তার পরিচিতি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সেমিনারে গিয়ে তিনি পরামর্শ দেন, মতামত দেন। তিনি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাতিন আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় ৩২টিরও অধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। বিভিন্ন দেশে বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তার। কবিতার মাঝেও সেই অনুভূতি তুলে ধরেছেন কখনও কখনও। বড় পরিসরে ভ্রমণ কাহিনীও লেখার ইচ্ছা আছে তার। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন গবেষণাধর্মী, প্রবন্ধ ও সম্পাদনামূলক এ পর্যন্ত তার লেখা নয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত।
বরাবরই মনজুর রশীদ ভীষণ স্বাপ্নিক এবং আপাদমস্তক প্রাণবন্ত এক মানুষ। সব দুঃখ-বেদনা, অপ্রাপ্তি উপেক্ষা করে জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসেন। কখনই কোনো টেনশন বা না পাওয়ার বেদনায় তিনি নিমজ্জিত হন না। তার ভাষায়- ‘এ জীবন বড্ড ছোট। এই সুন্দর পৃথিবীতে সবাইকে নিয়ে তাই জীবন উপভোগ করাই শ্রেয়।’ পেশার বাইরে তাই সময় পেলেই ভ্রমণে বের হন। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে চলে যান দূর থেকে দূরে। প্রকতির মাঝে খুঁজেন নিটোল আনন্দ। পারিবারিক কোনো মিলনমেলা হলে সবাইকে আনন্দে মুখরিত করতে কবিতা, গান পরিবেশনেও ভুল করেন না। তবে জীবনের এই সবকিছুর মাঝেই মানুষের অধিকারকে তিনি অগ্রগণ্য করে ফেলেন।
কবিতার বই দুটি প্রসঙ্গে কবি ও লেখক মনজুর রশীদ বলেন, ‘এই কাব্যগ্রন্থ দুটি চলমান সময়ের এক ভার্চূয়াল ডায়েরি। দীর্ঘ সময় ধরে বহমান এই পুঁজিবাদী সমাজে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালো থাকা-মন্দ থাকা, প্রেম-বিরহ, আবেগ-উদ্দীপনা, মানবিক ভিন্নতা, কল্পনা বিলাসিতা কিংবা নিঃসঙ্গতার আগ্রাসন ইত্যাদি যেমন মানুষের জীবনবোধে অনেক রকমের পরিবর্তন এনে দিচ্ছে একইসাথে চলমান নষ্ট রাজনীতির চক্করে পড়ে ক্রমাগতভাবে চারদিকে অসাধু, ভণ্ড ও তোষামোদকারীদের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। ফল হিসেবে সমাজে দ্বৈতনীতি, বৈষম্য, তথাকথিত দৃশ্যমানতার আড়ালে অদৃশ্য সামাজিক অসামঞ্জস্যতাসমূহ নাগরিক হিসেবে আমরা অনেকেই সেভাবে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি না। তাই এই বই দুটির কবিতাগুলোতে একদিকে জীবনলব্ধ অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন যেমন প্রেম নিয়ে আর্তনাদ, হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতিগাঁথা, অন্তরের মাঝে বয়ে চলা প্রমত্ত ঢেউ, সমাজে বিচিত্র সব চরিত্রের চিত্রণ এসব স্থান পেয়েছে।
তার লেখার বড় বৈশিষ্ট্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। কেন সমাজে বৈষম্যের বিভেদের প্রাচীর তৈরি হবে, সমাজে কেন অনৈক্যের সুর তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, ক্ষমতার সুযোগ পেয়ে কেন তার অতিরঞ্জিত অপব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাশে থাকা মানুষগুলো। এ প্রশ্ন তার কাছে নিত্য। দেশ, জাতি ও সমাজের এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহ তার হ্নদয়কে স্থির থাকতে দেয়না এক মুহূর্তও। তাই তিনি তার কবিতা ও বিভিন্ন লেখায় লিখে যেতে চান সব কথা। বিপ্লবের রক্তমাখা ইতিহাসের কথা তাকে সবসময় রোমাঞ্চিত করে। দ্রোহে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি লিখেছেন, ‘ দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন/ সবই পুড়ে ছারখার/ বঁচে থাকার স্বপ্নগুলো/ বাঁধ সাজছে বারবার।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি কবি মনজুর রশীদের লেখা দুটি কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, আল-জাজিরার বাংলাদেশ প্রতিনিধি তানভীর এ চৌধুরী, দীপ্ত টিভির চীফ নিউজ এডিটর এস এম আকাশ, বিজ্ঞাপনী সংস্থা এক্সপ্রেশনস এর পরিচালক আপন আহসান ও ত্রপা মজুমদার, পিকেএসএফ-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক ফজলুল কাদের, উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ টনি মাইকেল প্রমুখ। মনজুরের দুটি বই-ই প্রকাশ করেছে মূর্ধন্য প্রকাশনী। বই দুটি পাওয়া যাচ্ছে একুশের বইমেলার মূর্ধন্য প্রকাশনীর ৬৩৩ ও ৬৩৪ নং স্টলে। বই দুটির কাব্য ছোঁয়া আপনিও নিতে পারেন। কবি মনজুর রশীদের মতে, ‘ কবিতার মাঠে আমি কেবলই এক প্রতিবাদী লেখক। লিখে যাব মনের কথা, লিখে যাব অসাম্য আর বৈষম্যের কথা। লিখে যাব ভালোবাসার কথা। লিখে যাব মানুষকে আরও মানুষ হয়ে ওঠার কথা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)