রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের মানবিক সহায়তা ছাড়াও ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ঘটনায় অন্তত সোয়া এক ঘণ্টা পর খবর পাওয়ায় ততক্ষণে আগুন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল। যার কারণে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে। এছাড়া আগুন এক জায়গায় নয়, একাধিক স্থানে একসঙ্গে লেগেছিল।
বৃস্পতিবার ভোরে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
আগুনে পুড়েছে অন্তত দুই শতাধিক দোকান। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও আগুনের কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি। আগুন কেন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল, তাও উঠে এসেছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৩ টা ৪৩ মিনিটে প্রথম কল আসে ৯৯৯ থেকে। এরপর কল আসে আমাদের ১৬১৬৩ নাম্বারে। ৯৯৯ এর ডিরেক্ট কলেই মোহাম্মদপুর ও কল্যাণপুর ফায়ার স্টেশন থেকে ফাস্ট রেসপন্স করে। কিন্তু, আগুন ততক্ষণে ফায়ার সার্ভিসের ভাষায়- প্রাথমিক স্টেজ ছাড়িয়ে ডেভেলপমেন্ট স্টেজে চলে গেছে। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসকে দেরিতে খবর দেওয়া হয়েছিল। আর ডেভেলপমেন্ট স্টেজে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
আমরা প্রাথমিকভাবে আলামত সংগ্রহ করছি। আগুনের কী কী কারণ হতে পারে সেটাও আমরা নিরূপণ করছি। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, মশার কয়েল ও বিড়ি-সিগারেট থেকে আগুন লাগতে পারে। সঠিক কারণটা নিরূপণে সময় লাগবে।
আগুনের ভয়াবহতায় কৃষি মার্কেটের প্রায় ৪০০ দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মার্কেট ও কাঁচাবাজারে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৭০০-৮০০ দোকান ছিল। তবে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দাবি, অবৈধ দোকান ছিল ফুটপাতে। সিটি করপোরেশন থেকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া ছিল ৩১৭টি। এর মধ্যে পুড়েছে ২১৭টি দোকান।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন বেশি থাকে কৃষি মার্কেটে। রাত ১০টার পরে বিদ্যুতের সঞ্চালন মার্কেটে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যখন লোড বেশি থাকে তখন সাধারণত শর্ট-সার্কিট হয় না।
এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন আগুন যখন লাগার তখনও লাগলো না। লাগলো তখন যখন বিদ্যুতের লাইনও বন্ধ। রাত ১০টার পর শর্ট-সার্কিট হবে কীভাবে? এই আগুনে চক্রান্ত আছে।
নাশকতা নাকি সুনির্দিষ্ট কারণে কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত তা তদন্তেই বেড়িয়ে আসবে উল্লেখ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের লাইন যদি বন্ধই থাকবে, তবে সিকিউরিটি লাইট জ্বলছিল কীভাবে? সেটার নিশ্চয় আলাদা লাইনে ছিল না। তবে ওনারা যেটা দাবি করেছেন, সেটা যৌক্তিক যে লোড কম ছিল। কিন্তু দিনে আগুন লাগলে কেউ না কেউ নির্বাপণে এগিয়ে আসেন, কাজ করেন। আগুনকে প্রাথমিক স্টেজেই নির্বাপণ সম্ভব হয়। কিন্তু, রাতে বা ভোরে তো সাধারণত কেউ থাকেন না। তখন আগুন লাগলে সেটা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যেমনটা আমরা দেখেছি নিউমার্কেটে। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে কীভাবে আগুন লেগেছিল যা সিসিটিভি ফুটেজে উঠে এসেছিল।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অনেকেই সহযোগিতার নামে লুট করেছেন। আবার অনেকে দোকান থেকে বের করে রাখা মাল নিয়ে গেছেন। মালামাল লুটের বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা মার্কেটের নিরাপত্তায় কাজ করছি। সব গেটে পুলিশ সদস্যরা আছেন। কেউ কোনো অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
আগুন লাগার পাঁচদিন পর কৃষি মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়ার পর যেসব পণ্য নিচে পড়ে কিছুটা ভালো ছিল, সেগুলো নামমাত্র মূলে বিক্রি করছেন দোকানিরা । অন্যদিকে পুড়ে যাওয়া জুতার দোকান থেকে কিছু বেচে যাওয়া জুতা অল্প দামে বিক্রি করছেন দোকানিরা।
অনেক দোকানি কিংবা কর্মচারী পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে খুঁজে বের করে পোড়া চাল, সাবান, আটার প্যাকেট, লবণ সহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তিন ভাগের এক ভাগ দামে বিক্রি করছেন সেখানে। তাদের ভাষ্য এসব পণ্য তো ফেলেই দিতে হবে, যেগুলো একটু ভালো আছে সেগুলো বিক্রি করছেন কম দামে। আর এসব পণ্য কম দামে কেনার আশায় অনেককেই ভিড় করতে দেখা গেছে।
শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কৃষি মার্কেটের বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনি এ বিষয়ে অবগত আছেন। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব, ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।’
কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ মার্কেটের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। আমাদের চোখের সামনেই এই বাজার গড়ে উঠছে। এত বড় একটা ক্ষতি, প্রায় পাঁচ-ছয়শ পরিবার একদম সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। তারা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, আমরা সেই সহযোগিতা করব।’
ওইদিন মার্কেটের সামনে জেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি বুথ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরাও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি করছেন। ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা অতি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করব। তারপর আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মানবিক সহায়তা করার চেষ্টা করব।’