রাজধানীর কর্মাস কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহ হোসেন আয়ান। প্রায় এক বছর আগে মারা গেছেন আয়ানের বাবা মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহ হোসেন ইকবাল। কৃষি মার্কেটের দক্ষিণ প্রান্তে শাহ ইকবালের ভাড়া দেওয়া দোকানটি ছিল জুতার দোকান। তার রেখে যাওয়া দোকানটির ভাড়া দিয়ে চলছিল স্ত্রী রাজিয়া বেগম এবং একমাত্র সন্তান শাহ হোসেন আয়ানের জীবন।
শাহ হোসেন আয়ান বলেন, ‘১৯৯৬ সাল থেকে আমার বাবা এই মার্কেটের ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এই দোকানটি ছাড়া বলার মতো আর কিছুই নেই। তার মৃত্যুর পর এই দোকানের ভাড়া দিয়ে আমাদের খাওয়া, আমার পড়ালেখার খরচ চলত।’
পুড়ে যাওয়া দোকানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজিয়া বেগম। আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দোকানের দিকে তাকিয়ে বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। শোকে হতবিহ্বল আয়ান মা রাজিয়াকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে রাজিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী আমাদের জন্য এই একটাই দোকান রাইখা গেছে। এইটার ভাড়ার টাকা দিয়া আমরা কোন রকম মাস চলতাম। ১১ মাস আগে সেও চইলা গেল, আজকে দোকানটাও গেল।’
রাজিয়া বেগম জানান, ভোর রাতেই অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়েছিলেন তারা। পাশের জহুরি মহল্লা থেকে ছুটে এসেছিলেন আগুন নেভাতে। কিন্তু পানির সংকটে চোখের সামনে পুড়ে যেতে দেখেছেন দোকানটি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর আগে নিউ মার্কেট ও বঙ্গবাজারে আগুনের সময় তারা দেখেছেন আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের প্রধান উপকরণ পানি। কিন্তু রাজধানীতে আগুন নেভানোর মতো পানির উৎসের সংকট রয়েছে। এ মার্কেটের আগুন নেভাতে গিয়েও একই সমস্যার মুখে পড়ে ফায়ার সার্ভিস। পানির উৎস খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট হয় আর আগুনের লেলিহান শিখা আরও ছড়িয়ে পড়ে।
শওকত ট্রেডার্সের মালিক শওকত ইসলাম বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়েছিলাম ভোরে। কিন্তু আসতে আসতে দেখি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
মা এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী রানা বলেন, মালামাল যে বের করবো সে অবস্থাও ছিল না। প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে দোকানের ভেতরে যেতে পারিনি। চোখের সামনে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেছে।
কৃষি মার্কেটে নিজের পাঁচটি দোকান ও আটটা গোডাউন পুড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ বলেন: এই মার্কেট যদি ঝুঁকিপূর্ণই হবে তবে বন্ধ করা হলো না কেন? আগুন লাগলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পায় দোকান মালিক! কেন? আগুন লাগলে ক্ষতি তো হয় দোকান ব্যবসায়ীর, দোকান মালিকের হয় না।
ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান বলেছেন, মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজার (কৃষি মার্কেট) ঝুঁকিপূর্ণ ছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিটি কর্পোরেশনের এমন অভিযোগ করছে, মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ থাকলে ভেঙে দেওয়া হলো না কেন?
নাজমুল হাসান বলেন, মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এমন কোনো কাগজ আমরা পাইনি। তারা যদি জানতেন, তবে এটি ভেঙে দিতে পারতেন।
আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রাথমিকভাবে শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
রাতে আগুন লাগার পর প্রথমে ৭টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। পরে একে একে ১৭টা ইউনিট কাজ শুরু করে।
মার্কেটের ডান পাশের হক বেকারি থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এখন এ মার্কেটের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে শত শত দোকান।
বৃহস্পতিবার ১৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে লাগা আগুন। এর আগে বুধবার ১৩ সেপ্টেম্বর দিনগত রাত ৩টা ৪৩ মিনিটের দিকে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অগ্নিনির্বাপণ সাহায্যকারী দল।