ছয়শ বছর পার হলেও কমেনি তার রূপের খ্যাতি। অপরূপ রূপবতী, শহরের সেরা ধনী গণিকার কন্যা। নাচ-গানেও হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ পারদর্শী। হাজার পুরুষের কামনার সেই নারী, যাকে নিজের করে চেয়েছিলেন বিদরের রাজাও। কিন্তু ভাগ্যরেখায় কী ছিল তার? কিংবা জীবনের কাছে কী চেয়েছিলেন সে অনন্য রূপসী?
কিংবদন্তী হয়ে ওঠা সেই নারীর নাম কানহোপাত্র। ১৫ শতকে ভারতের মহারাষ্ট্রের পন্ধরপুরের কাছে মঙ্গলভেদ শহরের বিত্তশালী গণিকা শ্যামার মেয়ে। বাবার পরিচয় নেই। শহরের প্রভাবশালী পুরুষ সদাশিব তার বাবা হতে পারেন বলে মনে করতেন মা শ্যামা। মায়ের কাছেই নৃত্য ও সঙ্গীতে তালিম নিয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন কিশোরী কানহোপাত্র।
মহারাষ্ট্রের বিদরের রাজার বিশেষ অনুগ্রহ ছিল শ্যামার প্রতি। তাই শৈশব ঝাঁকজমকপূর্ণভাবেই কাটে কানহোপাত্রের। তবে অর্থবিত্ত ও আদর-যত্নে বেড়ে উঠলেও গণিকার সন্তান হিসেবে সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বিয়ে করাও ছিল নিষিদ্ধ। রূপবতী কানহোপাত্র সব পুরুষের নজর কাড়তেন।
শ্যামা চাইতেন মেয়েকে বিদরের রাজার কাছে পাঠাতে । বিদর রাজও তাকে যথাযথ সন্মান ও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কানহোপাত্র জাগতিক জীবনের বাইরে অনুসন্ধান করেছিলেন শান্তি। সব প্রত্যাখ্যান করে আশ্রয় খুঁজেছেন বিঠোবার (অবতার কৃষ্ণের আরেক রূপ) কাছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে পান্ধারপুরে তপস্বীর জীবনই বেছে নিয়েছিলেন তিনি।যেখানে জাত-কূল, সামাজিক বৈধতা, অস্পৃশ্যতার স্থান নেই। ভক্তির পরম সমর্পনে সেখানে মুছে যায় সব বাধা।
তিনি একমাত্র নারী বারকারি (ভক্তিবাদী সম্প্রদায়) সাধক, যিনি কোনও গুরু, পুরুষ সাধু, বংশ বা ঐতিহ্যগত পরম্পরা ছাড়াই একমাত্র তার ভক্তির ভিত্তিতে সাধুত্ব অর্জন করেছেন । কানহোপাত্র মারাঠি ভাষায় বহু আবহাঙ বা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন বলে ধরা হয়। যদিও মাত্র ৩০টি এখনো টিকে আছে। ‘সকল সান্ত গাথা’ নামের ‘আবহাঙ’ সংকলনে এসব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তার কবিতায় সমাজের অবিচারের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ-সংগ্রাম, মানবতাবাদ এবং নিজেকে সুরক্ষায় সমাজ থেকে পালিয়ে প্রভু বিঠোবার আশ্রয়ে একান্ত সমর্পনের কথা উঠে এসেছে। কবিতায় তিনি ঈম্বরের সাথে চিরন্তন ভালোবাসার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। ব্যতিক্রমী বিষয় যে, কিছু রচনায় তিনি বিঠোবাকে ‘মা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মহারাষ্ট্র জুড়ে তার আবহগুলো এখনও গাওয়া হয়।
কানহোপাত্রর অন্তর্বেদনার কারণ, ধরণ ইতিহাসের ধূলায় আজ ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু সে ব্যথাকে সফলভাবে প্রগাঢ় ভক্তির আনন্দে পরিণত করতে পেরেছিলেন তিনি। গণিকা-নতর্কী থেকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন সময়কে মুঠোয় ধরে ফেলা সান্ত্ বা সাধকে। তাই বহু শতাব্দী পার হয়ে কানহোপাত্রের অসাধারণ সৌন্দর্য, তার শিল্পকলায় পারদর্শিতা, তার প্রতি বিদর রাজার আগ্রহ, ঈশ্বরের প্রতি তার ভক্তিমূলক সম্পর্ক লোকগাথায় পরিণত হয়েছে। পন্ধরপুরের মন্দিরে বিঠোবার চরণে তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন বলে জানা যায়। তার সমাধিটিও মন্দিরের সীমানার মধ্যেই। আজও ভক্তিভরে স্মরণ করা হয় তার নাম।