তাঁর মুখে সর্বদাই গান। কথায় কথায় উঠতে বসতে আড্ডা দিতে দিতে তিনি গাইতেই থাকেন। গানই তাঁর সাধন-ভজন। গানই তাঁর জীবন-মরণ। গাইতে গাইতে তিনি কখনো কেঁদে উঠেন কখনোবা মুখে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। বুধবার ১৯ ডিসেম্বর সাভার রেডিও কলোনি পূর্ব জামসিং এলাকায় তাঁর বসতঘরটিতে চলে যাই। দেখে কাঙালিনী সুফিয়া গেয়ে উঠলেন—‘মাটির একটা ঘর বানাইয়া জীবন দিলাম শেষ করে/কেমন কইরা থাকব সেই মাটির ঘরে।’
বললাম -কাঙালিনী, আপনার এত দুঃখ কেন? কেন সারাজীবন গানে গানেই কাটিয়ে দিলেন? তিনি বললেন—‘দুঃখ কষ্ট জালা যন্ত্রণা বিরহ সব আমি গানের মধ্যে বিলীন কইরা দিই। আমাতে আমি থাকি না। যখন আমি গান গাই, আমি গান গাই নাকি কে গান গায় ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ বলতে পারব না।’
কাঙালিনী বললেন, ‘আমি তো আগের মতো নাই যে, একটা গান নিয়ে পড়ে থাকি। আমি বিভিন্ন নিত্য-নতুন গান রচনা করি। মুহূর্তেই আরেকটা গান গাইলেন—‘চাঁদের কোনে নয়ন দিয়া আমার আল্লা গেলেন গায়েব হইয়া/মানুষ হইয়া এই মানুষকে কেন চিনলা না।’
আশপাশের মানুষজন জড়ো হতে লাগলো কাঙালিনীর কণ্ঠ শুনে। জানতে চাইলাম মানুষের মুখে মুখে এখনো আপনার গান ফেরে, আপনার গান শুনে সবাই চলে আসলো, এতে আপনার কেমন লাগে? কাঙালিনী বলেন—‘আমার গান শুনে তো মানুষ পাগল হইয়া যায়। আর আমার কাছে-তো ভালোই লাগে, বড়ই আনন্দ লাগে।’
আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম কাঙালিনীকে। ঘর বানাইয়া কী লাভ, একদিন-তো কাঙালিনীও মইরা যাইব। গানে গানে দিলেন উত্তর তিনি—‘কত আশা কইরা বাধলাম বাড়িঘর/সেই ঘর গেলো আমার ভাঙিয়া।’ গানের গলা ছেড়ে কাঙালিনী বললেন- ‘কোনোরকম ছাউনি দিয়া তো অন্তত আমার জীবনটারে চালাইতে অইব। আমার জন্য ও আমার নাতি-নাতনিদের জন্য একখান ঘর বানাইবার চাইছি। ঘর খাড়া করতে অনেক কিছু লাগবে।
স্থানীয় ভাষায় তিনি বলেন, ‘মাঠের মধ্যি গাছের ভিতরে কাঙালিনী একখান বারি কিনছেন, সেই বারিতে ছাউনি দিবার পাইরছে না। ইট নাই, সিমেন্ট নাই, কী দিয়া কী করব। কামলারে টেহাই দিমু কোনবাই, ইট-বা কিনব কোহান থেকে। আর ঘর তুলব কেনবা —এই অবস্থায় আছি।’
আক্ষেপের সুরে কাঙালিনী বললেন, বাসে উঠতে পারি না। মাথা ঘুরায়, ব্যথা করে। এই যে অমুকেরে গাড়ি দিল, তমুকেরে গাড়ি দিল। আর আমি যে কাঙালিনী কি অপরাধই করছিলাম! আমাকে একটা গাড়ি দিল না। সরকারের কাছে আমার এইটুকু আবেদন -প্রতিমাসে দশ হাজার টাকা দেয় শেখ হাসিনা। কিন্তু আমি যে কাঙালিনী এখন চলতে পারি না। আমাকে যদি একটা ভাঙাচুরা একটা গাড়িও দিত তাও আমি সেই গাড়িতে উইটা চলাফেরা করতে পারতাম। এরকম সাহায্য আমাকে কে করব, কও। কেড়া বলে কইছে- ‘আমার গান শোনাবো কারেরে/বান্ধব বুঝি নাই সংসারে/ আমি গান শোনাব কারে?’
কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঙালিনী বললেন, আমি বাঁচতে পারি নাও বাঁচতে পারি। আমার সময় কাছে চলে আসছে। দেহের অবস্থা খুব খারাপ। বেঁচে থাকতে থাকতে আপনাদের চ্যানেলে (যে কোনো সংবাদমাধ্যম) যাতে আমাকে ডাকে।
কাঙালিনী তাঁর মৃত্যু ভাবনা জানালেন। বললেন- ‘আমি কাঙালিনী মারা যাব, কিন্তু আমাদের দেহের মধ্যে একজন আছে, সে তো আর মরবে না। সে-তো অমর। সে দেখতে পাইব যে কে আমাকে ভালোবাসে কে ভালোবাসল না। আমি শুধু খুঁজে খুঁজে সব জায়গায় দেখব কিন্তু আমারে কেউ চিনব না। আমার দেহটুকু পইচা যাবে। এই জন্যই তো মানুষ তাড়াতাড়ি করে মাটিচাপা দেয়। আমি তো মনে করি, আমি যদি কর্ম করি আমার এই দেহ নাও পঁচতে পারে। সশরীরে এরকম থাকতে পারি—এই আশাটাই আমি করি।’
কাঙালিনী জানান, ১৫ লাখ টাকার বেশি ধার-দেনা ছিল তাঁর। শেষ সম্বল জমিসহ বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে কিছু টাকায় ধার-দেনা পরিশোধ করে বাকি টাকা দিয়ে সাভারের রেডিও কলোনি পূর্ব জামসিং এলাকায় ৩ শতাংশ জমি কেনেন তিনি। তবে বাড়ি করার মতো টাকা নেই। পড়েছেন নতুন সংকটে। জানুয়ারি থেকে ভাড়া বাসায় উঠতে হবে পরিবার নিয়ে। প্রতি মাসের বাসা ভাড়া নিয়ে চিন্তিত তিনি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেওয়া প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোনোমতে চলছে তাঁর সংসার। একমাত্র ঋণের কারণেই কম দামে বাসাটুকু বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া কাঙালিনীর আর কোনো উপায় নাই।
কাঙ্গালিনী সুফিয়ার দেহের অবস্থা খুব খারাপ। ঠিকমতো হাঁটা-চলা করতে পারেন না। ভালোভাবে দেখতে পান না। পয়সা-কড়ির অভাবে ওষুধ ঠিকমতো খেতে পারেন না। ‘মাসে ১৫ হাজার টাকার আমার ওষুধ লাগে’—যোগ করেন কাঙালিনী।
দেশ-বিদেশে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশ হোক বিদেশ হোক, তারা যদি মনে করে, সারা জীবনতো কাঙালিনীর গান শুনলাম, তার জন্য কিছু করা যায় কী না। তাহলে কিন্তু আমি অভাবে থাকি না।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উদ্দেশ্যে কাঙালিনী সুফিয়া জানান, এখনো তিনি গান গাইতে পারেন, তাই সবাইকে গানের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর অনুরোধ জানালেন। সবাই যদি কাঙালিনীরে একটু দেখে তাহলে আর অভাবে থাকে না। আমি তো ভিক্ষা চাই না। গান গেয়ে চলতে চাই।
আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, এখন তো বুড়া হইয়া গেছি, এখন কেউ ঢাকে না। আগে চ্যানেল আইতে আমাকে ডাকতো, প্রোগ্রাম করাইতো। মুন্নী সাহা আমাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে গেছিল। দেশের বাইরেও যদি আমাকে নিয়ে একটা প্রোগামে করায় তাইলে আমার আর কোনো সমস্যা থাকে না। আমার বাড়িটা উঠে যাবে। সব চ্যানেল যদি আমাকে নিয়ে কিছু করে তাহলে কিন্তু আমি আর অভাবে থাকি না।