চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

বুলু শরীফ: গ্রামীণ জনপদের অনন্য সাংবাদিকের কথা

KSRM

প্রয়াত সাংবাদিক শরীফ মো. আমীরুল হাসান বুলু। মাগুরার সর্বমহলে যিনি ‘সাংবাদিক বুলু শরীফ’ হিসেবে এখনও অগ্রগণ্য এক নাম। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় তিনি পথিকৃতই বটে। আর এ কারণে গ্রামের মেঠোপথেও তিনি ব্যাপকভাবে নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছিলেন। সেই পরিচয়ে এখনও সামান্য ছেদ ঘটেনি। তাঁর মৃত্যুর পরও নামটি উজ্জ্বল হয়ে আছে সব মানুষের কাছে। মাগুরার গ্রামীণ জনপদে ‘সাংবাদিক বুলু শরীফ’ নামটি এখনও জনপ্রিয়।

সত্তর-আশির দশকে মাগুরা জেলার চারটি থানার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল যখন ছিল দুর্গম, পথঘাট থাকতো ধুলো আর কাদাময় তখন সংবাদের খোঁজে লালরঙের মটরসাইকেলে চড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটতেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে যেতেন, তাঁদের সুখ দুঃখের কথা শুনতেন। আর সেসবই লিখতেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়। আশির দশকে ঐতিহ্যবাহী সংবাদ পত্রিকার মধ্যে দিয়েই একজন পরিপূর্ণ সাংবাদিক হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশন এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকাতে কর্মরত ছিলেন। একই সাথে তিনি আইন পেশাতেও সক্রিয় ছিলেন।

Bkash July

১৮ মার্চ ছিল মাগুরার প্রয়াত এই জনপ্রিয় সাংবাদিক শরীফ মো. আমিরুল হাসান বুলু ওরফে বুলু শরীফের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন প্রেসক্লাবে কর্মরত অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর দ্রুত মাগুরা হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুতে সেদিন সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। সেদিন তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মাগুরার সাংবাদিকতা জগতের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায় ঘটে।

মাগুরার মতো একটি ছোট্ট জেলাতে সাংবাদিকতা করেও শরীফ মো. আমীরুল হাসান বুলু নিজের নামের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন গোটা খুলনা বিভাগেই। সাংবাদিকতার প্রতি আজন্ম ভালোবাসা এবং অনুসন্ধানী ও গবেষণামূলক সাংবাদিকতাকে অগ্রাধিকার কারণেই তিনি এমনটি হতে পেরেছিলেন। আর তাই অনেকের কাছেই তিনি অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিলেন। আশি ও নব্বই দশকে তাঁর হাত ধরেই মাগুরার অনেক তরুণের সাংবাদিকতা শুরু হয়। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়িও হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই।

Reneta June

সাংবাদিকতা ছিল তাঁর কাছে কেবলই নেশা। আর তাই দিনের পর দিন মটর সাইকেল নিয়ে ছুটে চলতেন মাগুরার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শত শত গ্রামে গিয়েছেন তিনি খবরের খোঁজে। যখনই খবরের সন্ধান পেয়েছেন তখনই ছুটে গিয়েছেন সেখানে। শত ঝুঁকি নিয়েও সত্যের সন্ধান করেছেন, পিছপা হননি কখনই। এখানেই শেষ নয়। যখন গ্রামের দরিদ্র নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের কাছে গিয়েছেন তখন শুধু তাদের কাছ থেকে ঘটনাই শোনেননি, আর্থিক সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজ পকেট থেকে গ্রামের অভাবী মানুষদের চাল, ডাল কেনার জন্য অর্থ দিয়েছেন। আর্থিকভাবে তিনি সবসময়ই স্বচ্ছল ছিলেন। আর তাই অভাবী, দরিদ্র মানুষের হাতে অর্থ তুলে দেওয়াটাও তিনি নিজের দায়িত্ব মনে করতেন।

সত্তর-আশির দশকে তিনি যখন সংবাদে কর্মরত ছিলেন তখন প্রখ্যাত মফস্বল সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনও দৈনিক সংবাদে কর্মরত। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার গ্রামেগঞ্জের ক্ষুধার্ত, মঙ্গা পীড়িতদের সংবাদ লিখে যিনি পাঠকের মন জয় করে ফেলেছেন। সেসময় সংবাদের জেলা প্রতিনিধিদের মধ্যে আরও যারা নাম ছড়িয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনÑ রাজশাহীর মলয় ভৌমিক, খুলনার মানিক সাহা, যশোরের রুকুনদ্দৌলা, পাবনার হাবিবুর রহমান স্বপন, দিনাজপুরের চিত্তঘোষসহ আরো কেউ কেউ। সংবাদের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে শরীফ মো. আমীরুল হাসান বুলুও তখন উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত।

শরীফ মো. আমীরুল হাসান বুলুর সাংবাদিকতা শুরু ছিল সত্তুর দশকের প্রারম্ভে। তিনি সে সময়কার জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ ও তৎকালীন বি.পি.আই নামীয় সংবাদ সংস্থায় মাগুরা থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। বি.পি.আই বিলুপ্ত হলে ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) মাগুরার প্রতিনিধিও ছিলেন। ১৯৮৫ বাসস ছেড়ে বাংলাদেশ বেতারের মাগুরা জেলা সাংবাদদাতা পদে নিয়োজিত হন। একই বছরে তিনি এক ঝাঁক তরুণকে নিয়ে মাগুরা থেকে প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘মাগুরাবার্তা’ প্রকাশ করেন। সেসময় মাগুরাবার্তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাগুরা বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। আশি ও নব্বই-এর দশক জুড়ে তিনি সংবাদ-এর ‘বুলু ভাই’ হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। মাগুরার বিভিন্ন বিষয়ের উপর সংবাদ পত্রিকায় তাঁর কয়েকশত অনুসন্ধানী রিপোর্ট, ফিচার ছাপা হয়। ২০০০ সালে তিনি প্রিয় সংবাদ ছেড়ে যোগ দেন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়।

খুলনা বিভাগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে জনপ্রিয় এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষায়ও তিনি কাজ করে গেছেন আজীবন। তিনি বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রেডিও বাংলাদেশ করেসপনডেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত মহাসসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাগুরা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের উপর ব্যাপক লেখালেখি করেন। আকবর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন-এর মুক্তিযুদ্ধের উপর ধারাবাহিক লেখা ‘আমি ও আমার বাহিনী’ তাঁর উৎসাহেই মাগুরাবার্তাতে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল। মাগুরায় সাংবাদিকদের পেশাগত উন্নয়নে তিনি প্রেসক্লাব গঠন ও প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন।

সামাজিক, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও শিক্ষা প্রসারে তাঁর ব্যাপক অবদান স্মরণযোগ্য। মাগুরা শিল্পকলা একাডেমির নির্বাচিত সদস্য, মাগুরা টাউন হল ক্লাবের নির্বাহী পরিষদে আইনজীবী সমিতির প্রতিনিধি এবং মাগুরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেন। মাগুরা সূর্যমূখী শিশু বিদ্যালয় ও পাঠশালা (কেজি)-এর তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও উপদেষ্টা হিসেবে অনন্য ভূমিকা রাখেন। স্থানীয় একাধিক সাহিত্য সংগঠনের কর্মতৎপরতায় সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন তিনি। নৃত্যকলায়ও তিনি অবদান রেখেছেন। ধ্রুপদী বা শাস্ত্রীয় নৃত্যে তিনি পারদর্শী ছিলেন। মাগুরাতে অনেক নৃত্যসন্ধ্যা তিনি আলোকিত করেছেন। আবার নিজে সৃষ্টি করেছেন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী। তিনি মাগুরা জেলা বণিক সমিতির পোপন ব্যালট পদ্ধতির নির্বাচনের সর্ব প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি আইন পেশায় সম্পৃক্ত হন। মৃত্যুর আগে স্ত্রী আইনুন নাহার হেনা, এক পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানকে রেখে যান।

আমাদের পরম শ্রদ্ধার সাংবাদিক শরীফ মো. আমিরুল হাসান বুলু ভাই কখনই রুটি-রুজির জন্য সাংবাদিকতা করেননি। সাংবাদিকতা করতেন মাগুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য অনুসন্ধান আর গ্রামীণ জনপদের অসহায় বঞ্চিত মানুষের কথা লেখার জন্য। মৃত্যু অব্দি সেই অঙ্গীকারেই একনিষ্ঠ ছিলেন। এরকম উচ্চমার্গের সাংস্কৃতিক মননের সাংবাদিকের শুন্যতা অপূরণীয়ই বটে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View