আমি, আমি তোমাদেরই লোক আমি, আমি তোমাদেরই ভাই আমার আর কিছু নাই, কেহ নাই
সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই প্রেম! ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ দিয়ে শুরু । তখন কতোটা বুঝতাম জানি না, তবে গানের সুর, ভরাট কণ্ঠ ভালো লাগতো খুব। বাসায় টেলিভিশন না থাকায় যে মানুষটি গাইছে তাকে দেখতে পারতাম না, কিন্তু ক্যাসেটের উপর মানুষটার ছবি দেখে মুগ্ধ হতাম। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল, লম্বা সাদা পাঞ্জাবি সাথে জিন্স!
ছবিটা দেখে নিজের মনের কথা গোপন রাখতাম। হতে চাইতাম তার মতো। কতোবার জিন্সের সাথে পাঞ্জাবি পরে আফসোস করতাম, চুল কবে বড় হবে? কবে তার মতো করে ঝাঁকড়া চুলে পাঞ্জাবি জিন্স পরে হাঁটবো!
তার সাথে শুধু শিল্পী-শ্রোতার যোগাযোগ নয়, তিনি আমাদের সেই সময়ের নিত্যদিনের যাপনেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সম্ভবত সত্যিকারের ব্যান্ডের এটা একটা বড় ম্যাজিক! আর সেই ম্যাজিশিয়ানটির নাম যদি হয় মাহফুজ আনাম জেমস, তাহলেতো প্রভাবিত না হয়ে উপায় নেই!
আমাদের শৈশব, কৈশোরে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগ ছিলো। স্বর্ণযুগ বলছি এজন্য যে আজকে যারা বাংলা ব্যান্ডের কিংবদন্তী, তারা তখন ছিলেন তাগড়া জোয়ান। তাদের কণ্ঠে ছিলো সেই তারুণ্যের গর্জন! নিত্য নতুন গান। বিশেষ দিবস এলে তো কথায় নেই! ঈদ, পূজা, ভালোবাসা দিবস কিংবা এরকম বিশেষ দিবসে নতুন গানের অ্যালবামের হিড়িক- এগুলোর চল তো এখন উধাও! আর সেই সময়ে এতো এতো বিকল্পের মধ্যেই জেমস ও তার গানের সাথে প্রেমের শুরু!
ক্যাসেট যুগে একক অ্যালবামতো বটেই, মিক্সড অ্যালবামে জেমসের একটা গান থাকলেও সেটা সংরক্ষণ করা ছিলো আমার কিংবা আমার মতো অনেকের নেশা! কতো যে পাগলামি ছিলো। দেখা গেলো, একটা মিক্সড অ্যালবামে জেমসের একটা গানই আছে, সেটাই বার বার ফিতা ঘুরিয়ে টেনে টেনে শুনতাম! মফস্বল হওয়ায় এতো ক্যাসেটের দোকান ছিলো না, তবুও যে কয়টা থাকতো আগে থেকেই বলে রাখতাম পত্রিকার সংবাদ পড়ে।
যখন উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার কারণে ঘর ছাড়ি, তখন প্রকাশিত হলো ‘দুষ্টু ছেলের দল’ অ্যালবামটি। তখনো ক্যাসেটের যুগ। থাকি ময়মনসিংহ শহরে। সি.কে ঘোষ রোডের অডিও দোকানগুলোতে দেখলাম সাদা রঙের পোস্টারে ছবি দিয়ে ক্যাসেটের বিজ্ঞাপন দেয়া। দেখেই অন্যরকম অনুভূতি কাজ করলো। বেড়ে গেলো ছটফটানি। ক্যাসেট বাজারে আসতেই কিনে নিলাম। মুক্ত জীবনে প্রথমবার শুনছি গুরুর গান। অ্যালবামের ‘থাকিস যদি পাশাপাশি’ গানটি দিয়ে শুরু হলো, হঠাৎই ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। আরে, চিরচেনা গলা কেমন যেন লাগছে! ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পাওয়ার কারণও আছে, তখন একটা গুঞ্জন হাওয়াই ভেসে বেড়াচ্ছিলো যে, ‘তার গলা নষ্ট হয়ে গেছে।’ পুরো ক্যাসেটটা কয়েকবার শোনার পর মনে হলো যেভাবে গাইলো ঠিকই তো আছে। মনে মনে যুক্তি তৈরী করে মনকে প্রবোধ দিলাম, হয়তো নতুনভাবে গাওয়ার চেষ্টা! কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে উদ্বেগ, সেটাকেতো বোঝ দেয়া যাচ্ছে না! সত্যিই কি জেমসের কণ্ঠে সমস্যা! যদি কিছু হয়ে যায়! কিন্তু সব আশাংকর অবসান ঘটে পরের গানে। সব ঠিক ঠাক!
শৈশব-কৈশোর পার হয়ে যৌবনেও তার গানে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তার কণ্ঠে সুরে আর ভাবমূর্তির কারণে এখনও তিনি আমার কিংবা আমাদের প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে এক মুগ্ধতার নাম হয়ে আছেন।
সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, জেমস ভক্তরা নাকি একটু পাগল হয়, কিংবা একটু একরোখা! এক প্রিয়জন জেমসের প্রতি মুগ্ধতা দেখে আমাকে বলেছিলেন ‘জেমস যদি তোমাকে বলে ছাদে উঠে লাফ দাও, তুমি মনে হয় তাই করবে’!
জীবনের সব মুহূর্তে সংগীত হয়তো দোল দেয় না, বা এটা সম্ভব ও নয়। কিন্তু জেমস, এমন একজন বাউলের নাম যার কণ্ঠ যাপিত জীবনে দুঃখ, বেদনা, প্রেম কিংবা নিঃসঙ্গতার কিনারে থাকা মানুষটিকেও দোল দিবে! সর্বাবস্থায়। উন্মাদনা সৃষ্টি করবে। আমি ভাগ্যবান যে এমন এক হৃদয়গ্রাহি নগর বাউলের সমকালে জন্মেছি। তারুণ্যকে উপভোগ করেছি সুরে তালে।
আমার শৈশবের প্রথম প্রেম, ভালোবাসার নাম জেমস। গুরু জেমস। সেই প্রথম দেখা থেকেই তার প্রতি আমুগ্ধ ভক্তি। যা এখনও চলমান। হয়তো আমৃত্যু সেই মুগ্ধতা বজায় থাকবে। শেষ বার তাকে মঞ্চে দেখেছি গত বছর। ২৭ জানুয়ারি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। প্রথমবার দেখে তারপ্রতি যে প্রেম অনুভূত হয়েছিলো, সেদিন দেখেও বুঝলাম- গুরুর প্রতি ভালোবাসা একটুও খাদ পড়েনি!