করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বজুড়ে থমকে যায় অর্থনীতি। দেশে দেশে সেই ধকল সামাল দেওয়া যায়নি। হাতে গোণা যে কয়টি দেশ অর্থনীতির চাকা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তার একটি বাংলাদেশ। তবে করোনার ধকল সামলাতে পারলেও এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুনিয়াব্যাপী চলা মূল্যস্ফীতির ঢেউ এসেছে বাংলাদেশেও। বেড়েছে নিত্যপণ্যসহ প্রায় সব দ্রব্যের দাম।
এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন: আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি এবং দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্ব। সংগত কারণেই কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধ উদ্ভূত অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করে দেশের সর্বস্তরের জনগণের জীবন-জীবিকা এবং সর্বোপরি ব্যাপক কর্মসৃজন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা এবারের বাজেটে প্রাধান্য পাবে। অর্থমন্ত্রীর সময়োপযোগী এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।
একইসাথে এবার প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) স্বাস্থ্য খাতের জন্য ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এবার ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এটা ইতিবাচক। কারণ, করোনায় স্বাস্থ্য খাতের অনেক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও চিকিৎসা ব্যয়ের বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতের জন্য জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়েও লাভ নেই বলে মনে করেন অনেকেই। কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, বরাদ্দ হওয়া অর্থ খরচ করতে পারে না তারা। বছর শেষে এই মন্ত্রণালয় টাকা ফেরত দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার দিকে নজর দিতে হবে বলে আমরা মনে করি।
এছাড়া দেশে প্রবাসী আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে নগদ প্রণোদনার হার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিদ্যমান ২.৫ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। ডলারের দামের টালমাটাল পরিস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলেই আমাদের আশাবাদ।
তবে করোনা পরবর্তী পরিবেশ খাতে গুরুত্ব দেওয়ার পরার্মশ থাকলেও গত দুই-তিন অর্থবছরে এ খাতের বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি। পরিবেশ খাতের প্রস্তাবিত বাজেট বরাবরের মতোই চমকহীন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত মোট বাজেট বরাদ্দ ১ হাজার ৫শ’ ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। উন্নয়ন খাতে ১ শ’ ৮৬ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ যাই হোক বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও আরও বেশকিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত দ্রব্যাদির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার শঙ্কা তৈরি করছে।
তবুও আমরা এবারের বাজেট নিয়ে আশাবাদী। করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির ধকল কাটিয়ে উঠে বাজেট বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ বাড়াতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এক্ষেত্রে দুর্নীতি ও কিছু ক্ষেত্রে অদক্ষতা বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা। সেই বাধা বরাবরের মতো কাটিয়ে উঠতেই হবে। এটা সম্ভব হলে বাংলাদেশ করোনার অভিঘাত পেরিয়ে আবারও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হবে।