ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের মাসিক বা ঋতুচক্র নিয়ে অনেক সংস্কার এবং কুসংস্কার আছে। এটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে পারিবারিক বা খোলামেলা পরিসরে এখনও কথা বলা হয় না। এটা এখনও নারীর গোপন বিষয়। নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয় সংস্কার ভাঙ্গতে ভারতে ‘পিরিয়ড চার্ট’ বা মাসিকের রুটিন প্রদর্শন শুরু হয়েছে।
কিছু উদ্যমী মেয়ে নিজ নিজ বাড়ির দরজা বা দেয়ালে এ তালিকা লাগিয়ে রাখতে শুরু করেছে। যেখানে উল্লেখ থাকে মাসের কোন তারিখে মাসিক শুরু হয়, কতদিন থাকে বা কোন তারিখে মাসিক শেষ হয়েছে। এ তালিকা তাদের ঋতুকালীন চক্র সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে মাসিক নিয়ে দীর্ঘ দিনের সংস্কার ভাঙ্গতেও সাহায্য করছে। যেটা নিয়ে নারীরা এখনও লজ্জায় থাকে, এই বিষয় নিয়ে কোন খারাপ লাগা থাকলেও কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না।
ভারতের হরিয়ানায় কানওয়ারি গ্রামে থাকেন ৩৩ বছর বয়সী সুপ্রিয়া ভার্মা। তিনি মাসিকের রুটিন টানিয়েছেন নিজ বাড়ির প্রবেশ দেয়ালে। সুপ্রিয়া মনে করেন, এটা তার মাসিকের প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত মাসিক হচ্ছে নাকি অনিয়মিত সেটা বোঝা যাচ্ছে। অনিয়মিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া সহজ হচ্ছে। যেটা নিকট অতীতে এতটা সহজ ছিল না।
সুপ্রিয়ার গ্রামের ৩৫টি বাড়িতে এখন মাসিকের রুটিন টানানো আছে। এতে মাসিক বা ঋতু নিয়ে খোলামেলা কথা বলা সহজ হয়েছে। এতে ওই গ্রামের নারীদের জীবন আরও সহজ হয়েছে।

সুপ্রিয়া আরও বলেছেন, “আগে মেয়েরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে কথা বলতে পারতো না। সে কারণে মাসিকের সময় ব্যথা বা অস্বস্তি নিয়েও কাজ কাজ করে যেতো। এখন পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন কোন সময়ে মাসিক হয়। সে সময় অন্যরা সচেতন থাকেন। পরিবারের নারী সদস্যকে কিছুটা হলেও আরাম দিতে পারেন। ”
সুপ্রিয়ার নিজের পরিবারের সদস্যরাও এখন অনেকটা সহযোগী বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিয়া। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, “এখন তারা বুঝতে পারেন আমাকে। কখন আমার একটু বেশী বিশ্রাম দরকার সেটা জানেন। আমি নিজের পরিবারে এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছি।”
মাসিকের তালিকা টানানোর এই ধারণাটি এসেছে ‘সেলফি উইথ ডটার ফাউন্ডেশন’ এর পরিচালক সুনীল জাগলান এর মাথা থেকে। এই ফাউন্ডেশনটি ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আওয়তায় বাবার সঙ্গে মেয়ের সেলফি তুলে পাঠানোর আহ্বান জানানো হতো।
মাসিক সংক্রান্ত ট্যাবু ভাঙ্গা এবং নারী স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে সুনীল জাগলান মাঝে মাঝে নারী সমাবেশের আয়োজন করেন। কারণ ভারতের নারীদের এখনও মাসিক সংক্রান্ত বিধিনিষেধের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। মাসিকের সময় নারীরা অপবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়। মাসিকের সময় নারীরা বিভিন্ন সামাকিজ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন না। কখনো কখনো নিজ বাড়ির রান্না ঘরেও নারীকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কোন কোন অঞ্চলে মাসিকের দিনগুলোতে নারীকে বাড়ির বাইরে আলাদা কক্ষে থাকতে হয়।
৩৮ বছর বয়সী বাবা সুনীল জাগলান বিবিসিকে বলেন, পারিবারিক পরিসরে মাসিক নিয়ে আমরা খোলামেলা কথা বলি না। কিন্তু আমার বড় মেয়ে যখন সাবালিকা হলো তখন আমি বিষয়টা অনুধাবন করেছি এবং চেয়েছি এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে খোলামেলা কথা হোক। আমি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনেছি। এ সময় মেয়েরা কী কী সমস্যা মোকাবেলা করে সে সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জেনেছি এবং আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। এসব আলোচনার সূত্র থেকেই মাসিকের রুটিন বিষয়টি মাথায় আসে।
ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মাসিকের রুটিন টানানোর চর্চাটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক হাজার মেয়ে এতে অংশ নিয়েছে। এদেশের বেশীরভাগই উত্তর প্রদেশ এবং হরিয়ানা রাজ্যের। এই চর্চা করতে গিয়ে অনেক মেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
সুনীল জাগলান বলেছেন, সামাজিক মাধ্যমে মাসিকের রুটিন শেয়ার করায় সবচেয়ে বেশী বাধা এসেছে। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ৯৯% পুরুষ।
পারিবারিক পরিসরে বাধার সম্মুখীন প্রিয়াঙ্কা ভার্মা জানিয়েছেন, বোনের বিয়ের সময় আমাদের বৃহত্তর পরিবারের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, বিয়ের অনুষষ্ঠানে অনেক ধরণের মানুষ আসবে। তারা এই জিনিস দেখবে সেটা দৃষ্টিকটু হবে। কেউ কেউ কাগজটি টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। আমি আবার তালিকা টানিয়েছি এবং সেখানে আমার বোনের রুটিনও যোগ করেছি।
সুনীল জাগলান জানিয়েছেন, দুই বছর আগে এই প্রচারণা শুরুর সময় ২ হাজার ৮শ রুটিন কার্ড বিতরণ করা হয়েছিলো। মাত্র ৩০% রুটিন কার্ড টানানো হয়েছিলো। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে।
সুনীল জাগলান এখন এই প্রচারণা নিয়ে অনলাইন কর্মশালাও করেন। মেয়েদের নিয়ে সমাবেশ করেন।