প্রকৃতি-পরিবেশ আর জীবনযাত্রার বহুবিধ পরিবর্তনের কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। মেয়েরা নানান ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বাড়িয়ে চলেছে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার। নারীরা এখন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ব্রেস্ট ক্যান্সারের পর জরায়ু মুখের ক্যান্সার নারীদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে চলেছে।
উইকিপিডিয়া বলছে, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের শতকরা ৩০ ভাগই হচ্ছেন জরায়ু মুখের ক্যান্সারের শিকার। কেননা এই অসুখে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেক নারী তা বুঝতে পারেন না। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরেই জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অবস্থান।
বিবিসি বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী এই জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং ৩ লাখ ১০ হাজার নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
জরায়ু ক্যান্সারকে বলা হয় ‘নারীঘাতক’। অনেকেই বুঝতে পারেন না তিনি যে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রধান কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে অসচেতনতা এবং অনেক বছরের অবহেলা। আমাদের দেশে প্রতি বছর দেশে ১০ হাজারের বেশি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মারা যায় এবং ৫ কোটিরও বেশি নারী এর ঝুঁকিতে আছে। জরায়ুমুখের ক্যান্সার বাংলাদেশে মহিলাদের মধ্যে দ্বিতীয় এবং বিশ্বব্যাপী চতুর্থ সর্বাধিক সাধারণ ক্যান্সার। বাংলাদেশে ক্যান্সারে নারী মৃত্যুর মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সার এখন দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্মূল করার জন্য, এইচপিভি ভ্যাকসিন প্রাথমিক পদক্ষেপ। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিনের এক বিশাল শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছে দেশের প্রথম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লি.। ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন দেশে প্রথমবারের মতো জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ভ্যাকসিন, প্যাপিলোভ্যাক্স বাজারজাত শুরু করেছে।
গত ২ আগস্ট মঙ্গলবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘জরায়ু মুখের ক্যান্সার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য একটি প্রচেষ্টা’ শীর্ষক এক সেমিনার এবং ইনসেপ্টার নতুন ভ্যাকসিন প্যাপিলোভ্যাক্স-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে দেশের এইচপিভি ভ্যাকসিনের (হিউম্যান পাপিললোমাভাইরাস) প্রয়োজনীয়তা এবং ক্যান্সার নির্মূলে নিয়মিত স্ক্রিনিং ও এইচপিভি ভ্যাকসিন (হিউম্যান পাপিললোমাভাইরাস) প্যাপিলোভ্যাক্সের সূচনা হলে কীভাবে এটি জরায়ু মুখের ক্যান্সার মুক্ত দেশ অর্জনে অবদান রাখতে পারে এ নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে দেশে এইচপিভি ভ্যাকসিনের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা প্যাপিলোভ্যাক্স কীভাবে পূরণ করতে পারবে এ বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। একই সাথে এই ভ্যাকসিনের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলোও সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। সেমিনারটি আয়োজন করে ওজিএসবি (অবসটেট্রিকাল এন্ড গাইনোক্লোজিক্যাল সোসাইটি অফ বাংলাদেশ)। সার্বিক আয়োজনে সহযোগিতা করে ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লি.।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. টিএ চৌধুরী এবং জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য প্রদান করেন। সভাপতিত্ব করেন ওজিএসবি (অবসটেট্রিকাল এন্ড গাইনোক্লোজিক্যাল সোসাইটি অফ বাংলাদেশ)-এর সভাপতি প্রফেসর ড. ফেরদৌসী বেগম। সেদিন অধ্যাপক ডা. গুলশান আরার স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেমিনার শুরু হয়। সেমিনারে বিষয়ের উপর উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইন অনকোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ডাক্তার সাবেরা খাতুন এবং ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস এর ম্যানেজার (এমএসডি) ফরহানা লাইজু। চমৎকার প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনা করেন ওজিএসবি-এর সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি প্রফেসর শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন। সেমিনারে ইনসেপ্টার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিঃ নির্বাহী পরিচালক ডা. ই এইচ আরেফিন আহমেদ। সবশেষে ইনসেপ্টার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্যাপিলোভ্যাক্স মোড়ক উন্মোচন মধ্যে দিয়ে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা করা হয়।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে ইনসেপ্টার নতুন ভ্যাকসিন ‘প্যাপিলোভ্যাক্স’ এক নতুন আশার সার করেছে। এটি দেশের ওষুধ শিল্পে একটি গর্বের বিষয়। কেননা ‘প্যাপিলোভ্যাক্স’ দেশ থেকে জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্মূল করার পথ প্রশস্ত করবে। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার এক নতুন উদ্দীপনাও তৈরি হয়েছে। এর আগে এ ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি। তাই এমন একটি ভ্যাকসিন চলে এসেছে একেবারে হাতের নাগালে। এখন যে কোনো ফার্মাতেই এই ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ায় অনেক সংশয়, ভয় কাটতে শুরু করেছে। শুরুতেই এটি প্রতিরোধ তৈরি করবে। দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও দারুণ খুশি।
জরায়ু ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো-হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ। জরায়ু ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত খুব কম উপসর্গ থাকে। বেশিরভাগ উপসর্গ পরবর্তী পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যে লক্ষণগুলো চোখে পড়ে সেগুলো হলো- শ্রোণী ব্যথা যা পিঠের ব্যথার সাথে হতে পারে। পা ফুলে যাওয়া। ঘন ঘন প্রসাব হওয়া। প্রসাবে রক্ত আসা। প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা। মলদ্বারে ব্যথা বা রক্তপাত। ঘন ঘন মূত্রনালীর সংক্রমণ। এ সব বিষয়কেই জরায়ু মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস এর ম্যানেজার (এমএসডি) ফরহানা লাইজু জানিয়েছেন, ‘প্যাপিলোভ্যাক্স’ ভ্যাকসিন ৯ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত সকল সুস্থ নারীকে দেওয়া যাবে। মোট তিনটি ডোজ নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জন্য নয়, তৃণমূলের নারীদের জন্য যতো এই ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা বাড়ানো যাবে ততই বাংলাদেশ জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্মূলের পথে ততোটাই এগিয়ে যাবে।