পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় দুই সপ্তাহের জামিন দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানি সংবাদপত্র ডন জানিয়েছে, ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার পরপরই মহাপরিদর্শক আকবর নাসির খানের বরাতে ইসলামাবাদ পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আল কাদির ট্রাস্ট মামলায়। যেখানে পিটিআই প্রধান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবির বিরুদ্ধে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছ থেকে কয়েক বিলিয়ন রুপি এবং কয়েকশ কানাল (পাকিস্তানে জমি পরিমাপের একটি একক, ১ কানাল=৫০৬ বর্গমিটার) জমি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
আল কাদির ট্রাস্ট মামলা কেন
ইসলামাবাদ-ভিত্তিক আবাসন কোম্পানি বাহরিয়া টাউন, ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বেগমের পরিচালিত আল-কাদির ট্রাস্ট এর একটি প্রকল্প আল-কাদির বিশ্ববিদ্যালয়কে সাড়ে চারশো কানালের বেশি (৫৬ একর) জমি দান করেছিল। আল-কাদির ট্রাস্ট মামলাটি সেই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মামলা।
দেশটির পিডিএম সরকার (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) অভিযোগ তোলে বাহরিয়া টাউন ওই জমি কোন অনুদান হিসেবে দেয়নি বরং এটি বাহরিয়া টাউনের প্রতিষ্ঠাতা মালিক রিয়াজ এবং ইমরান খানের সরকারের মধ্যে একটি গোপন চুক্তির ফলাফল ছিল।
সরকারের দাবি, আবাসন কোম্পানিটি ব্রিটেনে ১৯০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ছয় হাজার কোটি রুপি পাচার করেছিল। পরে ব্রিটিশ সরকার ওই সম্পদ জব্দ করে পাকিস্তান সরকারকে ফেরত দেয়।
এ ঘটনায় কোম্পানির মালিক রিয়াজ মালিকের বিরুদ্ধে করাচিতে মামলা দায়ের হয়। পরে সুপ্রিম কোর্ট মামলার রায়ে ৪৬ হাজার কোটি রুপি জরিমানার চুক্তিতে মালিক রিয়াজকে দায়মুক্তি দেয়।
সরকারের দাবি, বাহরিয়া টাউন এই দায়মুক্তির বিনিময়ে ২০২১ সালের মার্চে ঝিলম জেলার সোহাওয়া এলাকায় ৪৫৮ কানাল (৫৬ একর) জমি আল-কাদির ইউনিভার্সিটি তহবিলে দান করে। বাহরিয়া টাউনের সাথে ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির এই সমঝোতা হয়েছিল।
২০২২ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের জোট সরকারও অভিযোগ করে, তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকার বাহরিয়া টাউনের সাথে একটি চুক্তির বিনিময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবিকে কোটি কোটি টাকার জমি হস্তান্তর করেছে।
যেভাবে অভিযুক্ত হলেন ইমরান খান
২০২২ সালের জুনে মালিক রিয়াজ ও তার মেয়ের মধ্যে ফোনালাপের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। তখন বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। ওই অডিওতে তাদের ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির বন্ধু ফারাহ খানের বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
ইমরান খান সরকারের কিছু অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে কথা বলছিলেন তারা। ওই ফোনালাপে যে নারীকণ্ঠ শোনা যায়, ধারণা করা হয় সেটি মালিক রিয়াজের মেয়ের। তিনি বাবাকে বলছিলেন- ফারাহ তাকে বলেছেন, সাবেক ফার্স্ট লেডি তাকে ডেকে দুই ক্যারেটের হীরার আংটি নিতে অস্বীকার করেছেন, তার পরিবর্তে পাঁচ ক্যারেটের একটি আংটি দাবি করেছেন।
রিয়াজ পরে দাবি করেন, এর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত নয়। এক টুইটে তিনি বলেন, ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপটি ‘বানোয়াট’।
ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ অভিযোগ করেন, ইমরান ও তার স্ত্রী একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে মুদ্রাপাচার মামলা থেকে বাঁচাতে ৫শ কোটি রুপি এবং কয়েকশ কানাল জমি নিয়েছেন।
ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাহরিয়া টাউন যুক্তরাজ্যে একজন পাকিস্তানি নাগরিকের ব্যাংক হিসাবে অবৈধভাবে ৫ হাজার কোটি রুপি জমা করেছে। অর্থ জমার ঘটনাটি উদঘাটন করেছে যুক্তরাজ্যের এনসিএ, যারা পরে পিটিআই সরকারকে এ অপরাধের বিষয়টি জানায়।
পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো দাবি করেন, ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ইমরানের নির্দেশনা পেয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন তার জবাবদিহিতা বিষয়ক কর্মকর্তা শেহজাদ আকবর। যে অর্থ রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় কোষাগারের সম্পত্তি, সেই ৫ হাজার কোটি রুপির বিষয়টি নিয়ে বাহরিয়া টাউনের সঙ্গে মিটমাট করা হয়। এই ঘটনায় ইমরান ও তার স্ত্রীর জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে পরদিনই একটি কমিটি করা হয়।
সানাউল্লাহর তথ্য অনুযায়ী, বাহরিয়া টাউন কয়েকশ একর জমি দিয়েছে আল কাদির ট্রাস্টকে। আর এসব চুক্তিতে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অর্থের যোগানদাতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের স্ত্রী বুশরার স্বাক্ষর রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, অলাভজনক এই ট্রাস্টে মাত্র দুইজন ট্রাস্টি, তারা হলেন ইমরান খান এবং তার স্ত্রী বুশরা বিবি। তিনি জানান, আরো ২৪০ কানাল জমি দেওয়া হয়েছে ফারাহ শেহজাদির নামে।
এনএবির তদন্ত
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজ এবং তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পিটিআই চেয়ারম্যান ইসমরান খানের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আগে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) রিয়াজ এবং তার থেকে সুবিধা নেওয়া কয়েকজনকে ১ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়।
এনএবির নোটিসে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া এবং যুক্তরাজ্য থেকে অর্থ আনার ক্ষেত্রে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তদন্ত করতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এনএবির দাবি, পাকিস্তান সরকারের অর্থ ফিরিয়ে আনতে ব্রিটেনের এনসিএর সঙ্গে আদালাতের বাইরে সমঝোতা করেছিলেন আলী রিয়াজ মালিক এবং অন্যরা।
তলবী নোটিসে বলা হয়, মেসার্স বাহরিয়া টাউন আল কাদির ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির জন্য ঝিলাম জেলার সোহাওয়া তহসিল মৌজা বরকলায় ৪৫৮ একর, ৪ মারলা এবং ৫৮ বর্গফুট জমি দিয়ছে।
এর আগে, এনএবি ইমরান খানের মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্যকেও নোটিস পাঠিয়েছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- গোলাম সারওয়ার খান, মুরাদ সাঈদ, পারভেজ খাত্তাক, শাফকাত মাহমুদ, শিরিন মাজারি, আলী হায়দার জাইদি, হাম্মাদ আজহার এবং জুলফি বুখারি।
গত ২৯ নভেম্বর বুখারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এনএবি। কয়েক দফা শুনানিতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ার পর সবশেষ ১০ জানুয়ারি ফের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন তিনি।
ইমরান খান মঙ্গলবার দুটি মামলার শুনানিতে হাইকোর্টে হাজির হলে রেঞ্জার্স সদস্যরা তাকে আটক করে।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ বলেন, আল-কাদির ট্রাস্টের মামলায় ইমরানকে আটক করেছে এনএবি। এর বাইরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও কয়েক ডজন মামলার তদন্ত চলছে।