প্রথম রাউন্ডের লড়াই দিয়ে রোববার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের পর্দা উঠেছে। সাতটি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ২০ ওভারের ক্রিকেটের রোমাঞ্চকর যাত্রা। সাউথ আফ্রিকায় বসেছিল প্রথমটি। তৃতীয়টি ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ঘটনাবহুল আর উত্তেজনায় ঠাঁসা প্রতিটি আসরের স্মৃতি তুলে আনছে চ্যানেল আই অনলাইন। এপর্বে থাকছে ২০১০ মহাযজ্ঞের স্মৃতিগাঁথা।
বিংশ শতাব্দীতে ওয়ানডে ফরম্যাটে তিনবার ফাইনালে ওঠার পরও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার হতাশায় পুড়েছিল ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের জনক ইংলিশদের জন্য বিশ্বকাপ ট্রফিটা অধরা থেকে যাচ্ছিল। ২০ ওভারের ক্রিকেটে এসে তাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। প্রথমবার বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতে ব্রিটিশরা।
মজার ব্যাপার, সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপ আয়োজনেরই কথা ছিল না। মূলত হওয়ার কথা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি! সেই টুর্নামেন্ট আয়োজন না করে পরিবর্তে হয়েছিল টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ।
পাকিস্তানে ২০০৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর বসার কথা থাকলেও দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। নিয়মিত ঘটছিল আত্মঘাতী বোমা হামলা। বহু মানুষের হতাহতের মতো ঘটনা নিত্য হয়ে উঠেছিল। কোনো দলই তখন পাকিস্তানে খেলতে যেতো না। যার প্রেক্ষিতে টুর্নামেন্ট স্থগিত রেখে তা ২০১০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে হবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। পরে অবশ্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পরিবর্তে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়।
টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসে ২০০৭ সালে, দ্বিতীয়টি ২০০৯ সালে সালে। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণের দ্বিতীয় আসরের মাত্র ১০ মাস পরে বসেছিল আরেকটি বিশ্বকাপ।
২০১০ বিশ্বকাপে প্রথমবার আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে আফগানিস্তানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেবার তারা একমাত্র অ্যাফিলিয়েট সদস্যপদ থাকা দল হিসেবে বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পায়। বাছাইপর্বের ফাইনালে ওঠায় মূলপর্বে খেলার টিকিট পায় আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড। ফাইনালে আইরিশদের ৮ উইকেটে হারিয়ে বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েই বিশ্বকাপে গিয়েছিল আফগানরা। নেদারল্যান্ডস ও স্কটল্যান্ড বাছাইপর্বের বাধা টপকাতে পারেনি।
বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপটি মোটেও সুখকর ছিল না। গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়েছিল সাকিব আল হাসানের দল। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুল ৬৫ ও সাকিব ৪৭ রানের ইনিংস খেললেও জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ২১ রানে হেরেছিল টাইগার দল।
শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে উঠেছিল বিশ্বকাপের পর্দা। লো স্কোরিং ম্যাচে ১৩৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে কিউইরা এক বল হাতে রেখে ২ উইকেটের নাটকীয় জয় পায়।
দ্বিতীয় ম্যাচে ওই আসরের ফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়াকে বাগে পেয়েছিল লাল-সবুজের দল। আগে ব্যাট করা অজিরা ৭ উইকেটে ১৪৭ রানের বেশি তুলতে পারেনি। ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি সাকিব বাহিনী। ১১৪ রানে অলআউট হলে শেষ হয় তাদের সেবারের বিশ্বকাপ মিশন।
হার দিয়ে আসর শুরু করেছিল ইংল্যান্ড। শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আগে ব্যাট করে তুলেছিল ৫ উইকেটে ১৯১ রান। বৃষ্টি আইনে ক্যারিবীয়দের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৬ ওভারে ৬০ রান। এক বল হাতে রেখে ৮ উইকেটে জেতে স্বাগতিকরা। দ্বিতীয় ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে থাকলেও বৃষ্টির কারণে সেটি পরিত্যক্ত হয়। উইন্ডিজের কাছে আইরিশরা ৭০ রানের বড় ব্যবধানে হারায় রানরেটের বিচারে সুপার এইটে পৌঁছায় থ্রি লায়ন্সরা।
সুপার এইটে পা রেখেছিল- ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারত। সেখান থেকে সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান।
সনাথ জয়সুরিয়া, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকারাত্নে দিলশান ও কুমার সাঙ্গাকারাকে নিয়ে গড়া শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ সেমিতে বড় স্কোর পায়নি। দলীয় ৪৭ রানের মধ্যে এই চার ব্যাটার ড্রেসিংরুমে ফেরেন। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের ৫৮ রানের ইনিংসে তারা ৬ উইকেটে ১২৮ রান জমাতে পারে। টপঅর্ডার ব্যাটারদের দায়িত্বশীলতায় ৪ ওভার হাতে রেখে ৭ উইকেটের জয়ে ফাইনালে যায় ইংল্যান্ড।
দ্বিতীয় সেমিফাইনালের দৃশ্য ছিল বিপরীত। হাই-স্কোরিং ম্যাচে ছড়িয়েছিল উত্তাপ। উমর আকমলের ৫৬, কামরান আকমলের ৫০ ও সালমান বাটের ৩২ রানের ইনিংসে পাকিস্তান আগে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ১৯১ রান তোলে।
অস্ট্রেলিয়া ৮.২ ওভারে বোর্ডে ৬২ রান তুলতেই ৪ উইকেট খুইয়ে বসে। ডেভিড ওয়ার্নার ও শেন ওয়াটসন, ব্র্যাড হাডিন ও মাইকেল ক্লার্কের মতো ব্যাটারদের হারিয়ে অজিরা মারাত্মক চাপে পড়ে। পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে ডেভিড হাসি যখন আউট হন, ক্যাঙ্গারুদের জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪৫ বলে ৮৭ রান। সেসময় ক্রিজে নামেন মাইক হাসি।
ক্যামেরন হোয়াইট ৩১ বলে ৫ ছক্কায় ৪৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হলে নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের দিকে হেলে পড়ে। স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়ে স্টিভেন স্মিথ সাজঘরে ফেরার সময় অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৭ বলে ৪৮ রান। পরে ২২ গজে শুরু হয় মাইক হাসির ঝড়। ২৪ বলে ৩ চার ও ৬ ছক্কায় অপরাজিত ৬০ রানের ইনিংস খেলে তিনি কেড়ে নেন পাকিস্তানের মুখের হাসি। এক বল হাতে রেখে ৩ উইকেটের জয় এনে অজিদের ফাইনালে তোলেন ক্ল্যাসিক ফিনিশার।
১৯৮৭ সালের পর আবারও ফাইনালে মুখোমুখি হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। পার্থক্য বলতে প্রথম সাক্ষাৎ ছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপে, ২০১০-এ এসে তা টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটে। বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে ফাইনালে টসে জিতে মাইকেল ক্লার্কের দলকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান ইংলিশ অধিনায়ক পল কলিংউড।
৮ রানের ভেতর ৩ উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা হয় বিবর্ণ। পরে ২৭ বলে ২৭ রান করে আউট হন ক্লার্ক। অজিরা ৪৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বেশ বিপদে পড়ে। পঞ্চম উইকেটে ডেভিড হাসি ও ক্যামেরন হোয়াইট ৫০ রানের জুটি গড়লেও রানের গতি ছিল মন্থর। হোয়াইট ১৯ বলে ৩০ রানের কার্যকরী ইনিংস খেলন। হাসি ৫৯ রানের ইনিংস খেলতে খরচ করে ফেলেন ৫৪ বল। শেষপর্যন্ত দেড়শর কাছাকাছি যায় অজিরা। ২০ ওভারে ৭ উইকেটে সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৪৭ রান।
দলীয় ৭ রানে ইংল্যান্ড প্রথম উইকেট হারায়। লো স্কোরিং ম্যাচের পূর্বাভাস মিলছিল। সেই সম্ভাবনাকে ব্যাট হাতে ঝেটিয়ে বিদায় করেন উইকেটরক্ষক ব্যাটার ক্রেগ কিসওয়েটার ও কেভিন পিটারসেন। দ্বিতীয় উইকেটে তারা ১১১ রানের জুটি গড়ে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন। কিসওয়েটার ৪৯ বলে ৭ চার ও ২ ছক্কায় করেন ৬৩ রান। তারচেয়েও আগ্রাসী পিটারসেন ৩১ বলে ৪টি চার ও এক ছক্কায় ৪৭ রানের ইনিংস খেলেন।
কিসওয়েটার ও পিটারসেন আউট হলেও ফিনিশিংটা ঠিকঠাক মতো দেন কলিংউড ও ইয়ন মরগান। ৩ ওভার ও ৭ উইকেট হাতে রেখে একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মাতে ক্রিকেটের জনকরা।
৬৩ রানের ইনিংস খেলে ফাইনালের সেরা হন কিসওয়েটার। গোটা টুর্নামেন্টে দলের প্রয়োজনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন পিটারসেন, করেন আসরে দ্বিতীয় সর্বাধিক ২৪৮ রান। টুর্নামেন্টসেরার খেতাবটা পিটারসেনের ঝুলিতে যায়।
এক নজরে ২০০৭ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ
চ্যাম্পিয়ন: ইংল্যান্ড, রানার্সআপ: অস্ট্রেলিয়া। সেরা খেলোয়াড়: কেভিন পিটারসেন (ইংল্যান্ড)। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক : মাহেলা জয়াবর্ধনে (৩০২ রান, শ্রীলঙ্কা), সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি: ড্রেক ন্যানেস (১৪টি, অস্ট্রেলিয়া), সর্বোচ্চ ডিসমিসাল: কামরান আকমল (৯টি, পাকিস্তান), সর্বোচ্চ ক্যাচ: মাইক হাসি ও ডেভিড ওয়ার্নার (৮টি, অস্ট্রেলিয়া), সর্বোচ্চ জুটি: কামরান আকমল-সালমান বাট (১৪২ রান, পাকিস্তান)।