
ল্যাটিন আমেরিকান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা গঠনের মূলে প্রাচীন আরব তথা ইসলামিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা করেছেন নতুন প্রজন্মের গবেষকরা। এই গবেষণার বিষয়বস্তু বা ফলাফল ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। যা নিয়ে আগ্রহ বেড়েই চলেছে ল্যাটিন আমেরিকানদের।
আরব ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আরব নিউজ জানিয়েছে, দিন দিন ইসলামিক ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ বেড়েই চলেছে ল্যাটিন আমেরিকানদের। ব্রাজিলের রেসিফ শহরের বাসিন্দা মানসুর পেইসোটো অন্য একটি ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এরপর ২০১৪ সালে তিনি ‘হিস্টোরিয়া ইসলামিকা’ নামক প্রতিষ্ঠান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন মিশরে আরবি বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম, সেসময় আমি ‘মুর’ সম্পর্কে পড়তে শুরু করি। পর্তুগালের ওপর ইসলামিক প্রভাব সম্পর্কে সেই সময় শিখি, এরপর ব্রাজিলের সংস্কৃতিতে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি।’
৭১১ থেকে ১৪৯২ সালের মধ্যে আরব শাসকরা বর্তমান পর্তুগাল, স্পেন এবং ফ্রান্সের কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করে এবং স্পেনের একটি অঞ্চলের নামকরণ করে আল-আন্দালুস। যা এখন আন্দালুসিয়া নামে পরিচিত। আইবেরিয়ানদের প্রায় ৮০০ বছরের উপস্থিতি ঔপনিবেশিক ল্যাটিন আমেরিকায় অনেক প্রভাব ফেলেছিল। খ্রিস্টানদের পুনরায় ল্যাটিন বিজয়ের পর স্পেন ও পর্তুগালে ইসলামকে নিষিদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে ১৭ শতকের শুরুতে, অনেক মুসলিম ইউরোপীয়ই এই কারণে পরিবারসহ উত্তর আফ্রিকায় চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেকেই ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ গোপনে মুসলিম ছিলেন। এভাবেই ল্যাটিন আমেরিকায় মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব শুরু হয় এবং থেকে যায়।


সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় পর্তুগিজ ভাষার ওপর আরবি ভাষার প্রভাব সম্পর্কিত লেখাগুলি ‘হিস্টোরিয়া ইসলামিকা’র ওয়েবসাইটের অনুসারীদের দ্বারা সর্বাধিক শেয়ার করা হয়েছে। কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন, ৭০০ থেকে ১০০০ পর্তুগিজ শব্দ আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় এসেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে এর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। গবেষণায় উঠে এসেছে মজার তথ্য যেমন- ব্রাজিলের বেশ কিছু দৈনন্দিন শব্দের আরবি উৎস রয়েছে, যেমন আলফেস (লেটুস), আলমোফাদা (কুশন), আকুগু (কসাইয়ের দোকান) এবং গারাফা (বোতল)।
মুসলিম নির্মাণ শিল্পের বেশিরভাগই ১৬ শতকের দিকে আরব থেকে আমেরিকায় আসে। তাদের ব্যবহৃত কিছু শব্দ আজও রয়ে গেছে যেমন- অ্যালিসারস (ফাউন্ডেশন) এবং অ্যান্ডাইম (ভারা) ইত্যাদি।

ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে মুসলিম স্থাপত্যের প্রভাব এতটায় বেশি যে ঔপনিবেশিক যুগের গীর্জা, আটলান্টিক উপকূলের ভেরাক্রুজ থেকে দক্ষিণে ওক্সাকা পর্যন্ত স্পষ্টতই মুসলিম ‘মুরিশ’ শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। ল্যাটিন আমেরিকায় আসা মুসলিম অর্থাৎ মুরদের হাত ধরেই মূলত এই অঞ্চলে ঘোড়সওয়ার প্রথা এবং জাহাজ শিল্পের সূচনা হয় এইসব ক্ষেত্রে মুরদের ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ এখনও প্রচলিত আছে। গবেষণায় দেখা যায়, এই অঞ্চলের প্রথমদিকের বেশিরভাগ নাবিক এবং ক্রু মুর ছিল।

কয়েক শতাব্দী ধরে, মুররা অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠী যেমন গুয়ারানি আদিবাসীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আসছে ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত মুরেরা, কিন্তু এই অঞ্চলে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব আজও অনুভূত হয়।এই অঞ্চলের খাবার দাবারেও রয়েছে মুসলিম ল্যাটিন তথা মুরদের প্রভাব যেমন- ডুলসে দে লেচে অর্থাৎ ক্যারামেলাইজড মিল্ক, আর্জেন্টিনার সবচেয়ে সাধারণ পেস্ট্রি এমপানাডাসের উৎপত্তি আন্দালুসিয়ান শব্দ থেকে। এছাড়াও স্পেনে ৪,০০০ এরও বেশি শব্দ আরবদের থেকেই গৃহীত।

ইতিহাসবিদ রিকার্ডো এলিয়া কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকায় মুরিশদের উপস্থিতি বিষয়ে আর্জেন্টিনা এবং চিলির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ক্লাস নিয়েছেন। তিনি বলেন, আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ের মুররা আমাদের শব্দ উচ্চারণের পদ্ধতিতে প্রভাব ফেলে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, আর্জেন্টিনায় লেবানিজ এবং সিরিয়ান বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়রা এই বিষয়ে কখনই খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি বরং আর্জেন্টাইনরাই বিষয়টি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী ছিল। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এখন ল্যাটিন আমেরিকায় প্রথম মুসলিম বসতি স্থাপনকারীদের সম্পর্কে জানতে চাইছে।’ ল্যাটিন আমেরিকানদের এমন আগ্রহ দেখে তিনি এখন অনলাইন ক্লাস নেয়ার কথা ভাবছেন।
নিঃসন্দেহে ল্যাটিন আমেরিকা একটি বহুসাংস্কৃতিক মহাদেশ যা একাধারে বহন করে আসছে ইউরোপের আভিজাত্য, আমেরিকান আধুনিকায়ন এবং আরব তথা মুসলিম ঐতিহ্য।