১৯৮৭ সালে ‘বখাটে’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে পা রাখেন ‘রাত্রির যাত্রী’ খ্যাত নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবের। গত তিন দশক ধরে অর্জন করেছেন মানুষের ভালোবাসা। সরকারি অনুদানে এবার তিনি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন কথাসিাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে ‘যাপিত জীবন’ নামের আরও একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
দেশভাগ এবং ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে এক মর্মস্পর্শী আখ্যানটি সেলিনা হোসেন রচনা করেন সত্তরের দশকে। পাঠকপ্রিয় এই উপন্যাসে উঠে এসেছে দেশ ভাগের যন্ত্রণা আর পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে কণ্ঠ রোধ করবার অন্যায় চেষ্টা। প্রায় সত্তর বছর আগের প্রেক্ষাপট সিনেমার পর্দায় তুলে ধরা চাট্টিখানি কথা নয়। সেটা যেনো শুটিং শুরু করেই হারে হারে টের পাচ্ছেন নির্মাতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
যেহেতু ৭০ বছরের আগের প্রেক্ষাপট, তাই শুটিং সেটও চাই সেই সময়ের! চরিত্রের পোশাকপরিচ্ছদ থেকে শুরু করে আসবাব- সমস্ত কিছুই হওয়া চাই নিঁখুত। সেভাবেই প্রস্তুতিও নেয়া। তারপরেও টুকটাক জটিলতাতো এসে উপস্থিত হয় ই। নির্মাতা বলছেন, সর্বোচ্চ বিশ্বাসযোগ্য করে সেই সময়কে ‘যাপিত জীবন’ এর প্রতিটি ফ্রেমে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। আর এতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ভাবনা। সে আমার মেয়ে বলে নয়, একজন নির্মাতা হিসেবে বলছি- শুটিং সেটে এরকম সহযোগিতাপরায়ণ শিল্পী পেলে সবকিছু আসান হয়ে যায়!
চ্যানেল আই অনলাইনকে নির্মাতা হাবিব জানান, মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) থেকে রাজবাড়ি জেলায় শুরু করেছেন ‘যাপিত জীবন’ এর দৃশ্য ধারণ। টানা শুটিংয়ে প্রথম লটের কাজ শেষ হবে। সব ঠিক থাকলে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে হবে শুটিং। তবে প্রথম দিনের শুটিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার কথা জানিয়ে হাবিব বলেন, ‘যাপিত জীবন’ এর দৃশ্য শুরু হয়েছে ৫১ নম্বর দৃশ্য দিয়ে। এই ‘৫১’ কিন্তু আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বর্তমানে আমাদের স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এটা মোটেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কাকতালীয় ঘটনা। পরে বিষয়টি মনে করে পরিচালক হিসেবে বিষয়টি ভালো লাগছে।’ নির্মাতা জানান, আমার মেয়ে আশনা হাবিব ভাবনাকে দিয়ে ‘যাপিত জীবন’ এর ক্যামেরা ওপেন হয়েছে। প্রথম দৃশ্যে ভাবনা ছাড়াও শুটিংয়ে অংশ নিয়েছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ, আবুল কালাম আজাদ, তূর্য, সাদ সহ বেশ কয়েকজন।
তারকাবহুল এই সিনেমায় শুক্রবার সন্ধ্যায় অংশ নিচ্ছেন গুণী অভিনেত্রী ডলি জহুর। বৃহস্পতিবার শুটিংয়ে বঙ্গবন্ধুর যুবক বয়সের চরিত্রে অংশ নিয়েছেন সমাপ্তি মাসুক। শনিবার থেকে অংশ নিবেন আফজাল হোসেন। সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন রোকেয়া প্রাচী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রওনক হাসান, মৌসুমী হামিদ, গাজী রাকায়েত, তানভীর হোসেন প্রবাল, অতিথি শিল্পী হিসেবে আছেন কাজী হায়াৎ।
পিরিওডিক্যাল সিনেমা বলে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং মনে হলেও আত্মবিশ্বাসী নির্মাতা। বলেন,‘কঠিন জার্নি মনে হচ্ছে, বিশেষ করে সেই সময়টাকে ধরা। ৭০ বছর আগের সবকিছু তুলে ধরা, চায়ের কাপ থেকে শুরু করে সবকিছু। আর্টিস্ট কোনো কিছু নিয়ে এসে অভিনয়ের সুযোগ এই সিনেমায় পাচ্ছেন না। সবকিছু অ্যারেঞ্জ করতে হচ্ছে আমাদেরই। অসম্ভব চ্যালেঞ্জিং মনে হলেও সেই সময়ের কাছাকাছি যেতে পারছি বলে মনে হচ্ছে।’
নির্মাতা বলেন,‘সিনেমাটি করতে কোনো কম্প্রোমাইজ করছি না। ছাড় দিচ্ছি না কোথাও। চরিত্র থেকে শুরু করে আর্ট, কোথাও ছাড় দিচ্ছি না। এটা সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে। রাষ্ট্র আমার উপর দায়িত্ব দিয়েছে, আমি ফাঁকি দিতে চাচ্ছি না। সম্ভাব্য বাজেটের মধ্যে না হলে লগ্নি করে হলেও এটা ঠিকঠাকভাবে করতে চাই। এটা আমার কর্তব্য।’
মেয়ে ও নায়িকা ভাবনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হাবিব বলেন, নিজের চরিত্রটি কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে পর্দায় তুলে ধরা যায়, এই ভাবনা ছাড়াও টোটাল প্রোডাকশনে তার সহযোগিতা আমাকে আপ্লুত করছে। বলা যায়, ‘যাপিত জীবন’ এর সাথে ভাবনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
নির্মাতা বলেন, ‘আমার কন্যা হিসেবে বলছি না, ও অসম্ভবরকম সহায়তা করছে আমাদের। প্রথম দিন ভোরবেলা শুটিং ছিলো। কিছুটা শঙ্কা ছিলো। কিন্তু শুটিং শুরুর ভোরে সবার আগে উঠেছে সে। উল্টো আমাকেই কল টাইম সম্পর্কে অবহিত করেছে। আমি খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার সিনেমা মনে করে সবার শেষে উঠতে পারতো, সেটে আসতে পারতো সবার শেষে, সবার শেষে মেকাপ করতে পারতো- কিন্তু সেটা সে করেনি। তার এমন পেশাদারী আচরণ আর সিনেমা নিয়ে তার এমন আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি।’
শুধু মেয়ে নয়, ‘যাপিত জীবন’ শুরুর পর থেকে অন্যান্য অভিনয়শিল্পী, ক্রুদের কাছ থেকেও দারুণ সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে জানান হাবিব। তিনি বলেন, সিনেমার শুটিং শুরুর আগে পারফেকশনের জন্য অনেক বিষয় ছিলো। লুক টেস্ট, রিহার্সেল- সবকিছু প্রপারলি করতে পেরেছি, কারণ সিনিয়র থেকে জুনিয়র সমস্ত শিল্পীরাই আমাদের সেই সুযোগটি দিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা না পেলে কাজটি কঠিন হতো।
সেইসঙ্গে রাজবাড়ির স্থানীয় প্রশাসন, সাবেক মেয়র নিজাম থেকে শুরু করে রাজবাড়ি বাসীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান হাবিব। তিনি বলেন, সবাই দারুণভাবে সহায়তা করছেন। সাবেক মেয়র নিজাম সাহেব, উনি নিজের বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য। সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। নির্মাতা মনে করছেন, শিল্পী কলাকুশলী থেকে শুরু করে সবাই যেভাবে ‘যাপিত জীবন’ এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে দারুণ কিছু উপহার দিতে পারবো।