রিদুয়ান ইসলাম:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে গণহত্যা চালায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। আর সেই গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী আলবদর-রাজাকার লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। এ গণহত্যার স্মারক হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় এই ভাস্কর্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটি। এটি তৈরি করেছেন খ্যাতনামা শিল্পী ভাস্কর রাসা। সম্প্রতি নতুন রং করে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতো। এরপর মৃতদেহের স্তূপ সাজিয়ে গণকবর দেয়া হতো।
সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান এটি উদ্বোধন করেন। ভাস্কর্যটি দু’টি অংশে বিভক্ত। এর এক অংশে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের অংশ নেয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি আর অপর অংশে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র।
ভাস্কর্যের নিচে রয়েছে পানি, যা দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে। আর পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, যা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতায় বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার ভাবনা আসে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখনো তা পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ভাস্কর রাসা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এগুলো হলো একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও বিজয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যে পাঁচটি থিমের দু’টি তুলে ধরা হয়েছে। বাকি তিনটি থিম প্রশাসনের সহায়তায় অতি দ্রুত নির্মাণ শেষ হবে বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ভাস্কর্যটির যে অংশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাতকে। এই অংশে দেখানো হয়েছে, ঐ রাতে ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছেন, পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে, মরদেহ ফেলে রাখা হচ্ছে যেখানে সেখানে। পরের অংশে দেখা যায়, সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন প্রশিক্ষণ নেয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধস্পৃহার ছাপ রয়েছে। আর এমন সব যুদ্ধকালীন চিত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভাস্কর্যটি। আর এটিই বাংলাদেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য হিসেবদে পরিচিত।