চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

আদিম: সিনেমার আঙ্গিকের এক নান্দনিক নিরীক্ষা

KSRM

বিশ্ব চলচ্চিত্রের নানা বাঁক বদলের এই সময়গুলোতে কোন ফিল্মমেকার কী ধরনের কন্টেন্ট নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেই ছবিটি তিনি কীভাবে বানাচ্ছেন! অর্থাৎ সিনেমার বিষয় বস্তুকে ছাপিয়ে সিনেমার আঙ্গিক এখন সৃজনশীলতার সবচেয়ে বড় পরিমাপক। আর এর সবচেয়ে শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হলো সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত তরুণ নির্মাতা যুবরাজ শামীমের প্রথম চলচ্চিত্র “আদিম”।

আদিমের গল্পে মানুষের চিরচেনা অস্তিত্বের যাতনাই উঠে এসেছে। অর্থাৎ সেই আদিম প্রবৃত্তি যেমন খুন, পরকীয়া, যৌন ঈর্ষা এগুলোই প্রস্ফুটিত হয়েছে। কিন্তু আদিম যেখানে অনন্য হয়ে উঠেছে সেটা হলো তার নির্মাণ শৈলী। অর্থাৎ বিষয়ের তুলনায় আদিম ছবির আঙ্গিক ছবিটিকে মাস্টারপিস করে তুলেছে। সিনেমার ভাষা আর নান্দনিকতাকে নিয়ে ইচ্ছা মতো খেলেছেন পরিচালক। তাই হয়তো “আদিম”কে চিনতে ভুল করেননি মস্কোর জুরি বোর্ডের সদস্যরা। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার “সিলভার সেন্ট জর্জ” তুলে দিয়েছেন “আদিম” নির্মাতার হাতে। এই পুরস্কারটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসেও একটি মাইল ফলক।

Bkash July

একটা প্রচণ্ড বাস্তবধর্মী আর জীবন্ত ছবির সব বৈশিষ্ট্য আদিমে রয়েছে এবং তার ভেতর দিয়েই পরিচালক সিনেমার চিরাচরিত ফর্ম ভেঙ্গে চুরে একাকার করে দিয়েছেন। আমির হামজার হ্যান্ড হেল্ড সেইকি ক্যামেরা যেন কিছু বাস্তব চরিত্রকে অনুসরণ করে গেছে মাত্র। কোন কৃত্তিমতা নেই চিত্রগ্রহণে। ফোকাস একটানা থাকলো কী থাকলো না থোড়াই কেয়ার যেন। আসলেই তো মানুষের জীবনও তো এমন। সব সময় কী ফোকাস থাকে! ড্রিম সিকোয়েন্সে সোহাগী পুরোপুরি ক্যামেরায় অর্থাৎ দর্শকের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছে, “আমি তো কালার বউ”। এই ধরনের নিরীক্ষা মৃণাল সেনের “ইন্টারভিউ” ছবিতে যদিও আমরা এর আগে দেখেছি তবে “আদিম” এ সেটি ভিন্ন রূপে বাঁক নিয়েছে।  ডি সিকা যেমন “বাই সাইকেল থিফ” করার সময় একজন সত্যিকারের শ্রমিককে কাস্টিং করেছিলেন আদিমেও তেমনি যুবরাজ শামীম টঙ্গী জংশনের রেলওয়ে বস্তি থেকে পরম যত্নে তুলে এনেছেন কালা, ল্যাংড়া কিংবা সোহাগীদের। আর এখানেই এই ছবির বাজিমাত। চরিত্রগুলো কখনোই অভিনয় করেননি। তারা যা তাই করেছেন যেন। এমনকি ল্যাংড়া চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তিনি কোন নাম করা উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়ে গেলেও বিস্মিত হবার কিছু ছিলো না।

“আদিম” এর ডিটেলিং অন্য মাত্রার। যেহেতু স্টেশনের গল্প তাই ট্রেনের ব্যবহার ছিলো দেখার মতো। প্রতিটা টেনশন সিনের ব্যাকগ্রাউন্ডে চলন্ত ট্রেন দেখিয়েছেন পরিচালক। সিনেমার ইতিহাসের সাথে ট্রেনের গতির সম্পর্ক বেশ পুরনো। আর আদিম সিনেমায় এই গতি যেন মানুষের জীবনের বহমানতা। শেষ দিকের খুনের দৃশ্যেও একটা অশুভ সিলুয়েটের ছায়ামূর্তি তৈরি করার জন্য পরিচালক প্রয়োজনীয় আলো নিয়েছেন চলন্ত ট্রেনের হেডলাইট থেকে। আদিমকে ঠিক পুরোপুরি নিও রিয়ালিজমের মতো সাদা কালোয় সমাজ বাস্তবতা বলা যায় না। কখনো কখনো সাদা কালো ছাপিয়ে হালকা রং দেখিয়েছেন পরিচালক আর পুরো ছবিই রঙের স্যাচুরেসন ডাউন করে অনেকটা ইস্টম্যান কালারের মতো রেখেছেন। এই ধরনের ব্যতিক্রমী রং বিন্যাস ছবিটির স্বকীয়তাকে জোরালো করেছে।

Reneta June
আদিমের একটি দৃশ্যে সোহাগী

নারী প্রধান পরিবার “আদিম” সিনেমার একটা বিশেষ দিক। কালা’র সাংসারিক উদাসীনতার ভিড়ে সোহাগী যেন এক দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন নারী। সংলাপেও বলতে শোনা যায় যে কীভাবে যে সে সংসারটা চালাচ্ছে একমাত্র সেই জানে। আমাদের সমাজে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাওয়া এমন সোহাগীদের সংখ্যা অনেক। এছাড়াও ব্যাকগ্রাউন্ডে লোকাল গানের বক্তব্যে উঠে আসে সে দরিদ্র পরিবারের নারীরা কীভাবে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেও পরিবারের পুরুষদের অবহেলার পাত্র হয়ে থাকে।

একেবারে প্রলেতারিয়েত মানুষদের গল্প তুলে ধরেছে আদিম। কিন্তু সেখানে শুধু দরিদ্রতাকেই গল্পের পুঁজি করেননি নির্মাতা। এমন না যে চরিত্রগুলো ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকেরই সৎ কিংবা অসৎ নিজস্ব জীবিকার রাস্তা আছে। নিজেদের মধ্যে পাওয়ার রিলেশনও আছে। ল্যাংড়া নিজে বাস্তুহারা অথচ একদিন গভীর রাতে সে আরেক ছিন্নমূলকে ঘুম থেকে টেনে উঠিয়ে বলে যে এই ঘুমানোর জায়গা শুধুই তার। এইযে আধিপত্যবাদ সব শ্রেণিকেই গ্রাস করে রেখেছে। সব মিলিয়ে বস্তির দারিদ্র্যের গণ্ডি পেরিয়ে নির্মাতা তুলে এনেছেন এক আদিম সত্তা।

“আদিম” ছবির সম্পাদনার টেবিলে অহেতুক খুব একটা শট কাটেননি পরিচালক। বেশিরভাগ শট মাস্টার আনকাট রেখেছেন। অর্থাৎ চিরাচরিত ঢঙের ধারে কাছেও যাননি তিনি। কিন্তু তার ভিড়েও যখন দরকার পড়েছে তখন দেখিয়েছেন কিছু শক্তিশালী ক্লোজ আপ। যেমন কুকুরকে লাথি দেবার পর দুজনের চোখের অভিব্যক্তি কিংবা কলসিতে পানি ভরার সময় পানি পতনের ক্লোজ আপ।

বিদেশের মানুষ এই ছবিটাকে যতোটা না পছন্দ করেছে তার চেয়ে বেশি পছন্দ হওয়া উচিত এদেশের মানুষের কারণ ছবিতে অনেক জায়গায় আমাদের পরিচিত কিছু অসাধারণ গানকে স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো হয়েছে যে গানগুলো বাঙালিদের কানেই বেশি আনন্দ দিবে। আবার আমাদের জনপ্রিয় খল অভিনেতা ডিপজলের কিছু রগরগে সংলাপ ছবিতে দারুণ অর্থপূর্ণভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো তো আমাদেরই বেশি উপভোগ করার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় ফর্মূলা সিনেমার ভিড়ে উন্নত রুচির সিনেমা কোন কালেই খুব একটা দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। এটা পরিচালক যুবরাজ শামীমও ভালো করেই জানেন। উনার একটা ইন্টারভিউতে উনি বলেছেন ‘দর্শকের কাছ থেকে উনার কোন এক্সপেকটেশন নেই’। আসলেই তো। যে দেশে ভালো ছবির সঠিক বিপণন হয় না সেখানে আশা না করাই যৌক্তিক। তবে উনি হয়তো বসে নেই। “আদিম” এর মতো উনার পরের ছবিগুলোও হয়তো বৈশ্বিক দর্শকেরা আপন করে নিবে।

লেখক: জিৎ দে, চলচ্চিত্রকর্মী
I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View