একবাক্যে সবাই স্বীকার করছেন, চলতি বছরটা বাংলা সিনেমার জন্য সুপ্রসন্ন ছিল। বছরের শুরুতে সিনেমা সংশ্লিষ্টরা যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন, হয়তো ব্যবসায়িক সাফল্য ওতটা পূরণ হয়নি, তবে ভালো বাংলা সিনেমা যে এখনো মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখে, সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে বিশেষ করে দুই ঈদে।
এ বছর ৫১টির মতো দেশীয় ছবি এবং ৬টি ভারতীয় ছবি মুক্তির মাধ্যমে ২০২৩ সালের ঢালিউডের সিনেমার মুক্তির খতিয়ান শেষ হতে যাচ্ছে।
বছরটা শুরু হয়েছিল ‘ব্ল্যাক ওয়্যার’ মুক্তির মাধ্যমে। ১৫ ডিসেম্বর বছরের সর্বশেষ (৫১তম) দেশের ছবি মুক্তি পায় ‘ফ্ল্যাশব্যাক ৭১’। আলোচনা তৈরি করে আরিফিন শুভর ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ বছর শুরুতে মুক্তি পেলেও বছরের শেষ বাংলা ছবিটি মুক্তি পায় নিষ্প্রাণে! এদিকে, হলগুলোতে যখন দেশের ছবি শূন্যতা বিরাজমান, তখন শাহরুখ খানের আমদানি করা ছবি ‘ডানকি’ মুক্তি দেয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু মাল্টিপ্লেক্সগুলো দেদারসে চলছে ‘ডানকি’।
৫১টি বাংলা ছবির মধ্যে সর্বাধিক আলোচনা তৈরি, দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা এবং লগ্নীর চেয়ে কয়েকগুণ অর্থ রিটার্ন তুলেছে ‘প্রিয়তমা’ এবং ‘সুড়ঙ্গ’। হিমেল আশরাফ এবং রায়হান রাফী পরিচালিত এই ছবি দুটি ঈদুল আযহায় মুক্তি পেয়েছিল। ‘প্রিয়তমা’ সুপারস্টার শাকিব খানের ছবি, আর সুড়ঙ্গ-এ ছিলেন আফরান নিশো, এ ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত হন। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘প্রিয়তমা’ ইন্ডাস্ট্রি হিট এবং ‘সুড়ঙ্গ’ ব্লকবাস্টার।
সিনেমার ইতিহাসে ‘প্রিয়তমা’র মেগা হিটে নতুন রেকর্ড গড়েছেন ঢালিউডের বরপুত্র শাকিব। এ যাবৎ ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া ছবিগুলোকে পিছনে ফেলে তালিকায় ‘নাম্বার ওয়ান’-এ জায়গা করে নেয় ‘প্রিয়তমা’। প্রযোজক আরশাদ আদনান জানান, বিশ্বব্যাপী ‘প্রিয়তমা’ গ্রস কালেকশন ৪১ কোটি টাকা। ‘সুড়ঙ্গ’র প্রযোজকরা জানিয়েছেন, তারা ছবি থেকে লগ্নী তুলে ফেলেছেন। কিন্তু কতো টাকা গ্রস কালেকশন হয়েছে সেই তথ্য প্রকাশ করেননি।
এ বছর আমদানিতে হিন্দি ছবি আসা শুরু হয়। ‘পাঠান’ এর পর ‘কিসি কি ভাই কিসি কা জান’, ‘জওয়ান’, ‘অ্যানিমেল’, ‘মানুষ’ (বাংলা) এবং ২১ ডিসেম্বর আসে ‘ডানকি’। এসব ছবির মধ্যে শাহরুখের ‘জওয়ান’ ছবিটি একযোগে মুক্তি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি দর্শক এটি উপভোগ করেন। তবে হিন্দি সিনেমা এলেই দেশের সিনেমা হল চাঙ্গা থাকবে বলা হলেও সার্বিকভাবে আদতে সেই চিত্র দেখা যায়নি। মাল্টিপ্লেক্সগুলো লাভবান হলেও সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোতে হিন্দি সিনেমা চলছে, এমন নজির পাওয়া যায়নি। সিনেমার ম্যাংগো পিপলরা বলছেন, মানসম্মত দেশের ছবি দরকার।
এদিকে, এ বছর দর্শকদের কাছ থেকে হিট তকমা পেয়েছে রোজার ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘লিডার’ এবং ‘জ্বীন’ ছবি দুটি। দুটি ছবি দেখতেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ভিড় জমায়। মুক্তির পর ছবি দুটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়া এবং জাজ মাল্টিমিডিয়া নিজেদের ছবিকে সুপারহিট দাবি করে।
এর পাশাপাশি বছর জুড়ে দর্শকদের কাছ থেকে সর্বাধিক প্রশংসা অর্জন করেছে শেখ মুজিবের বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতীর রূপকার’। যুবরাজ শামীম পরিচালিত তারকাহীন ছবি ‘আদিম’ এবছর সমালোচকদের দৃষ্টিতে অন্যতম সেরা ছবির তকমা অর্জন করে। ছবিটি গেল বছর মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দুটি পুরস্কার অর্জনের পর দেশের দর্শক আগ্রহী হয়ে উঠেন। এছাড়া ১৯৭১ সেইসব দিন, আম কাঁঠালের ছুটি, সাঁতাও অন্তর্জালের মতো ছবিগুলোর প্রশংসা করেছেন চিত্রসমালোচকরা।
দেশ ছাপিয়ে বাংলা ছবি এ বছর বিশ্ববাজারে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহে টানা ছয় সপ্তাহ চলেছিল ‘প্রিয়তমা’। ‘সুড়ঙ্গ’ নিয়েও প্রবাসীদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াতে ‘প্রহেলিকা’ বেশ দর্শক দেখেছে। শুধু এই তিন দেশ নয়, চলতি বছর ‘প্রিয়তমা’ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি চলেছে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ডেও! প্রবাসীরা দলে দলে নিকটতম থিয়েটারে যান। এই চিত্র দেখে নতুনকরে প্রযোজকরা নতুন নতুন ছবি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে ভিনদেশে মুক্তির জন্য পরিবেশকদের সঙ্গে আলোচনা করে নিচ্ছেন। সিনেমায় এই সুবাতাস সবচেয়ে বেশি এ বছর চোখে পড়ে। পরিবেশকরাও বলছেন, ভালো ছবি দিতে পারলে ভিনদেশ থেকে কোটি টাকা তোলা সম্ভব।
এদিকে, বরাবরের মতো নিজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি ‘প্রিয়তমা’র বৃদ্ধ লুক ও গান দিয়ে এ বছর স্কুল টিনেজ, এলিটক্লাস, রুচিশীল এবং মাল্টিপ্লেক্স কেন্দ্রিক দর্শকদের মনে তার মজবুত অবস্থান তৈরি করেছেন। ‘সুড়ঙ্গ’ দিয়ে অভিষিক্ত হয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করলেও ছবি মুক্তির সময় একাধিক মন্তব্যের জেরে নিশোকে সমালোচনায় পড়তে হয়।
নিয়মিতদের মধ্যে চলতি বছর ‘ব্ল্যাক ওয়্যার’ ছবি দিয়ে সিক্স প্যাক বানিয়ে আলোচনার জন্ম দেন আরিফিন শুভ। পরে তিনি হাজির হন মুজিবের বায়োপিকের মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে নতুন করে ‘অভিনেতা’ হিসেবে সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন শুভ। অনন্ত জলিল ‘কিল হিম’ আনেন। অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন, অন্তর্জাল এবং মুজিবে বিশেষ চরিত্র দিয়ে থাকলেও সিয়ামের বছরটি মোটেও অনুকূলে ছিল না।
গেল বছর সবচেয়ে সম্ভাবনা দেখালেও শরিফুল রাজ এ বছর ছিলেন বিগ স্ক্রিনে অনুপস্থিত। পরাণ, হাওয়া ও দামাল দিয়ে আলোচনায় এলেও এ বছর তার কোনো ছবিই মুক্তি পায়নি। তবে ওটিটি প্লাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছে তার অভিনীত নিয়ামুল মুক্তার ‘রক্তজবা’। বাপ্পী চৌধুরীর জন্য বছরটি মোটেও সুখকর ছিল না। তার ‘শত্রু’ মুক্তি পেলেও ব্যবসায়িকভাবে বিপর্যয় ঘটে।
অভিনেতা সজলের এ বছরের ‘ফিল্মি জার্নি’ ছিল বেশ সন্তোষজনক। দর্শকদের কাছে তিনি ‘জ্বীন’ এবং ‘১৯৭ সেইসব দিন’ ছবি দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেন। এ বছর আদর আজাদের ‘লোকাল’ ও ‘যন্ত্রণা’ দুটি ছবি মুক্তি পায়। রোযার ঈদে ‘লোকাল’ ছবির ট্রেলার প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি নজর কাড়লেও পরে জ্বলে উঠতে পারেননি। রোশানের ‘জ্বীন’ ও ‘পাপ’ দুটি ছবি মুক্তি পায়। এরমধ্যে রোজার ঈদে ভৌতিক গল্পের ছবি প্রচারণায় কৌশল অবলম্বন করায় ‘জ্বীন’ ছবি আলোচনায় আসে। নিরবের ‘ক্যাসিনো’ ও ‘ফিরে দেখা’ দুটি মুক্তি পায়। সাইমন প্রেক্ষাগৃহে এসেছিলেন ‘লাল শাড়ী’ নিয়ে।
নায়িকাদের মধ্যে পরীমনি, অপু বিশ্বাস, বিদ্যা সিনহা মিম, বুবলী, তমা মির্জা, পূজা, ঐশীদের ছবি মুক্তি পেলেও খুব একটা আলাদা কিছু দেখা যায়নি। এরমধ্যে ‘প্রিয়তমা’র জন্য কলকাতার নায়িকা ইধিকা পাল এবং ‘সুড়ঙ্গ’র জন্য তমা মির্জা অভিনয় দিয়ে প্রশংসা কুড়ান। প্রহেলিকায় বুবলীর অভিনয়ও পছন্দ করেছেন দর্শক।
স্টার সিনেপ্লেক্স ও যমুনা ব্লকবাস্টার সহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি জানায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর বাংলা সিনেমা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ঈদে পরিবার নিয়ে মানুষ এতটাই হলমুখী হয়েছেন যে, হলিউডের বিশ্ববিখ্যাত ছবিগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। অগ্রিম টিকেট ক্রয়ের জন্য কাড়াকাড়ি ছিল। ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতির পাশাপাশি দেশে সিনেমা নিয়েও মানুষ মাতামাতি করেছে। সিনেমার জন্য এটি সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।
এক নজরে দেখে নিন এ বছরের সিনেমাগুলো ১. ব্ল্যাকওয়ার ২. অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন ৩. সাঁতাও ৪. ভাগ্য ৫. বীরকন্যা প্রীতিলতা ৬. কথা দিলাম ৭. মন দিয়েছি তারে ৮. বুবুজান ৯. মায়ার জঞ্জাল ১০. ওরা ৭ জন ১১. জে কে ১৯৭১ ১২. একটি না-বলা গল্প ১৩. রেডিও ১৪. লিডার- আমিই বাংলাদেশ ১৫. লোকাল ১৬. জ্বীন ১৭. শত্রু ১৮. আদম ১৯. কিল হিম ২০. পাপ ২১. প্রেম প্রীতির বন্ধন ২২. আদিম ২৩. মা ২৪. সুলতানপুর ২৫. আমি টোকাই ২৬. যেমন জামাই তেমন বউ ২৭. ফিরে দেখা ২৮. ফুলজান ২৯. প্রিয়তমা ৩০. সুড়ঙ্গ ৩১. প্রহেলিকা ৩২. লাল শাড়ি ৩৩. ক্যাসিনো ৩৪. মাইক ৩৫. গোয়িং হোম ৩৬. সেই সব দিন ৩৭. আম কাঁঠালের ছুটি ৩৮. এম আর- নাইন ৩৯. ঘর ভাঙা সংসার ৪০. সুজন মাঝি ৪১. অন্তর্জাল ৪২. বৃদ্ধাশ্রম ৪৩. দুঃসাহসী খোকা ৪৪. ইতি চিত্রা ৪৫. মুজিব ৪৬. মেঘের কপাট ৪৭. অসম্ভব ৪৮. যন্ত্রণা ৪৯. আজব ছেলে ৫০. মৃত্যুঞ্জয়ী ৫১. ফ্ল্যাশব্যাক ৭১
ঢাকা/এনই/এমটিএল